রুদ্র অয়নের ছোটগল্প: “বন্ধুত্ব”

প্রকাশিত: ৩:৪৬ অপরাহ্ণ, মে ১৪, ২০২০ | আপডেট: ৩:৪৬:অপরাহ্ণ, মে ১৪, ২০২০
 
বিস্ময় নয়নে ল্যাপটপ স্ক্রীনটার দিকে চেয়ে আছে রিচা। সবুজে শ্যামলে ছাওয়া বাংলাদেশ নামের একটা দেশের রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত, দশম শ্রেণীর ছাত্রী সে । তার স্বপ্ন মহৎ ও সাহসী সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার গড়ার। এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখে সে।
প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে একবার ল্যাপটপটা খুলে না বসলে রিচার মনে শান্তি হয়না।  প্রতিদিনের পড়াশুনার খুঁটিনাটি বিষয় ইন্টারনেটে যেমন সে দেখতে ভালোবাসে, তেমনি ফেসবুকে কাজ করতেও মন্দ লাগে না। শুধু আড্ডা দেয়াই নয়। রিচার বয়সী ছেলেমেয়েরা ফেসবুক দিয়ে এখন দেশ পাল্টে দিতে পারে। মূমুর্ষ রোগীর রক্ত যোগাড় করা থেকে শুরু করে রাজাকারবিরোধী আন্দোলন, জনসচেতনতামূলক বার্তা – সবই তো হয় আজকাল ফেসবুক নেট দুনিয়ায়।
 
আজকের ব্যাপারটা একটু আলাদা। সকাল থেকে দিনটা তো ভালোই চলছিল। কিন্তু ব্রাউজার ওপেন করার সাথে সাথেই রিচার সামনে একটা ম্যাসেজ ওপেন হয়। অদ্ভুত ভাষার ম্যাসেজ! এমন ভাষা সে আগে আর কখনোই দেখেনি। গুগল ট্রান্সলেটর দিয়েও কোনো কাজ হয়না। যায়-ই হোক গুগল তো মানুষেরই আবিষ্কার। মানুষ যে ভাষা জানেনা তা গুগল জানবে কেমন করে! পরপর তিনবার এরকম অদ্ভূত ভাষার মেসেজ পেল রিচা।
গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভয়টাকে জয় করার চেষ্টা চালাতে লাগলো সে। তবে যতটা না ভয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কৌতুহল হচ্ছে রিচার । কি করা যায়, কিভাবে এই ম্যাসেজের মর্মার্থ উদ্ধার করা যায় ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল সে।
 
পরেরদিন শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। সামনে পরীক্ষা, কিছু পড়াশুনা করা দরকার। ফিজিক্স বইটা খুলে দেখতেই রিচার মনে পরে গেল আগের দিনের ম্যাসেজটার কথা। পড়াশুনা মাথায় ওঠলো!  ম্যাসেজটা ওপেন করে তার  অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করতে থাকে সে। সহসা একটা বুদ্ধি মাথায় আসে তার। ম্যাসেজটির অর্থ না বুঝলেও রিপ্লাই করে সে। ইংরেজিতে লিখে দেয়, ‘তুমি কে জানিনা। যে ই হও না কেন, তোমার ভাষা বুঝতে পারছিনা!  বাংলায় অথবা ইংরেজিতে লেখ, তাহলে বুঝতে পারব।’
রিপ্লাই করে রিচা পড়তে বসে কিন্তু পড়ায় কি আর মন বসে! বারবার ল্যাপটপ খুলে খুলে চেক করে কোনো রিপ্লাই এসেছে কি না। 
 
সন্ধ্যার কিছু আগে হঠাৎ নোটিফিকেশন বাটন টা জ্বলজ্বল করে ওঠে। নোটিফিকেশন  চেক করার পর রিচা’র চোখ যেন ছানাবড়া!
সাহস করে দুইবার মেসেজটা পড়ে একদম স্তব্ধ হয়ে যায় রিচা। পরিষ্কার বাংলা ও ইংরেজী দু’ভাষায় লেখা, ‘আমি তোমাদেরই প্রতিবেশী। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই আমাদের বসবাস। তবে তোমাদের থেকে অনেক দূরে। কিয়েটো নক্ষত্রের সামুরাই গ্রহে আমরা থাকি। তোমাদের পৃথিবীটা অনেক নীল। আমাদেরটা তেমন নয়। এখানে তিনভাগ স্থল আর একভাগ জল। পৃথিবীকে কখনো ভেতর থেকে দেখিনি, তবে এবার তোমাদের রেডিও সিগন্যাল পেয়ে মনে হল যোগাযোগ করি। কি জানি যদি পৃথিবী ঘুরে আসার একটা সুযোগ পেয়ে যাই!’
 
হাজার বছর আগে নাসার বিজ্ঞানীদের পাঠানো রেডিও সিগন্যালের যে এত বছর পর এভাবে রিপ্লাই আসবে তাই ভেবেই বিস্ময়ে বিমূঢ়!
 
কয়েকদিন কেটে গেল। রিচা ও এলিয়েনের বন্ধুত্ব হয়েগেল। মনে মনে এলিয়েনটার একটা নাম ও দিয়েছে রিচা। জ্যাক আলবার্ট। রিচার স্বপ্নের রাজকুমার।  এলিয়েনটার সাথে কথা বলে সে যা বুঝল ওরা সব ভাষা পারে। নারী পুরুষের ভেদাভেদ থাকলেও নাম ব্যাপারটায় ওরা এখনো ঠিক অভ্যস্ত হয়ে ওঠতে পারেনি। প্রথম কয়েকদিন এভাবে চলল। কিন্তু এবার এলিয়েনটা পৃথিবী দেখতে চায়। ওদের সামুরাই গ্রহে রঙের বৈচিত্র নেই। নীল আর সবুজের মায়ামাখা নেই। তাই সেই গ্রহের প্রাণীরা জীবনে একবার পৃথিবী ঘুরে যেতে পারলে ধন্য বোধ করে। এসব কিছু রিচাকে জানিয়েছে জ্যাক আলবার্ট। পৃথিবীতে তো সে আসতেই পারে। কিন্তু এখানে তাকে আশ্রয় দেবে কে? ফলশ্রুতিতে সেই দায়িত্ব নিতে হল রিচাকেই।
 
এক রাতে খাবার খেয়ে বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। চুপি চুপি পায়ে হেটে রিচা ছাদে যায়। আগেই জ্যাক কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে রিচাদের বাসার অক্ষরেখা দ্রাঘিমারেখা। রাত ১১ টা ৫৯ মিনিট।  ছোট্ট কমলা সাইজের একটা স্পেসক্রাফট চোখে পড়ল রিচার। আস্তে আস্তে বড় হতে হতে সেটা এরোপ্লেনের আকৃতি নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিচাদের ছাদে ল্যান্ড করে। আর সেই স্পেসক্রাফট থেকে নেমে আসে রিচা’র কল্পনার রাজপুত্রের চেয়েও অনেক গুণ সুন্দর একটা প্রাণী। গল্প উপন্যাসে এলিয়েন দের যেরকম ভয়াবহ চেহারা দেয়া হয় জ্যাক আলবার্ট মোটেও সেরকম নয়। অনেক বেশি সুন্দর আর বন্ধুসুলভ। স্পেসক্রাফটে করে পৃথিবী ঘুরতে বের হয় তারা।
 আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে চলে এই স্পেসক্রাফট। আর তাই ওরা অতীতেও যেতে পারে। প্রথমেই রিচা জ্যাক আলবার্টকে দেখিয়ে আনে বাংলাদেশের ইতিহাস ৫২, ৬৯, ৭১, ৭৫ আর ২০২০….
জ্যাক আলবার্ট এর হৃদপিন্ড মানুষের মত মাংসাশী নয়, গাছপালা প্রকৃতি আর পাথরের দলা দিয়ে তৈরি। মানবীয় আবেগ অনুভূতি খুব সহজে তাকে স্পর্শ করেনা। সেই পাথরের হৃদয় ফেটেও জল আসে এত রক্তে লেখা বাংলাদেশের ইতিহাস দেখে । রিচা বলে, ‘এত রক্ত, এত অশ্রুর বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীনতা,  এত জীবনের দামে পাওয়া এই বিজয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আজও বিজয়ের স্বাদ পেলনা এদেশের আপামর জনসাধারণ! আজও নির্যাতন ধর্ষণের স্বীকার হয় নারী! আজও সাধারণের জীবনের নিরাপত্তা নেই! অত্যাচার অনাচার অবিচার দূর্নীতি খুন সন্ত্রাস – এসব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অতি-আবশ্যক।’
জ্যাক বলল, ‘একটা কিছু করা দরকার। আমার বিশ্বাস তোমাদের ভাল ও সৎ কিছু লোক আর আমাদের গ্রহের কিছু মানুষের বন্ধুত্ব স্থাপন হলে হয়তো আমরা ভাল কিছু উপহার দিতে পারবো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে।
ওরা প্রজন্ম  চত্বর দেখে। গ্রামের মেঠোপথ আর সোনালী ফসল, কৃষকের মুখে হাসি দেখে। শহীদ মিনার থেকে স্মৃতিসৌধ,  টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে পুরো পৃথিবী ঘুরে আসে ওরা। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি,  মিশরের পিরামিড আর রাজস্থানি দুর্গ জ্যাক আলবার্ট এর সামনে যেন জীবনের চিত্র তুলে ধরে। এ জীবনের সাথে তার কখনই পরিচয় হয়নি।
যাত্রা শেষ করে আবার সেই রিচার বাসার ছাদে এসে ল্যান্ড করে স্পেসক্রাফট। ততক্ষণে রাত ভোর হয়ে এসেছে। রবার্ট কে ফিরে যেতে হবে তার নিজের জগতে। রিচা জ্যাক আলবার্টকে উপহার দেয় বাংলাদেশের এক মুঠো মাটি আর লাল সবুজের একটি পতাকা। পৃথিবীর স্মৃতি হয়ে জ্যাক আলবার্টের কাছে থাকুক এগুলো। ওদের জগতে তো কোনো লাল সবুজ পতাকা নেই।

আপনার মতামত লিখুন :

লেখক রুদ্র অয়ন। ঢাকা