সুুষ্ঠু পরিকল্পনায় ঘাটতির কারণে করোনা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে: টিআইবি

প্রকাশিত: ৩:০৩ অপরাহ্ণ, জুন ১৬, ২০২০ | আপডেট: ৩:০৩:অপরাহ্ণ, জুন ১৬, ২০২০
“সুুষ্ঠু পরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতা ও সুশাসনের ঘাটতির কারণে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে;  
মোকাবিলায় সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে সুশাসন নিশ্চিতে ১৫ দফা সুপারিশ টিআইবির”
 
 
ঢাকা, ১৫ জুন ২০২০: দেশে করোনা ভাইরাসের বিস্তারের পূর্বে প্রস্তুতি নেয়ার মত পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও ভাইরাসটি মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকে ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ঘাটতি এবং বিভ্রান্তিকর ও পরস্পরবিরোধী নানা কর্মকান্ডের কারণে দেশে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। এছাড়া এই সঙ্কটকালে দীর্ঘসময়ের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের ঘাটতি ও অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দের কারণে স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতা আরো গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। করোনা সংক্রমনের ১০০তম দিনে ‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এসময় সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে ১৫ দফা সুপারিশ প্রদান করে সংস্থাটি।
 
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর-ই-খোদা এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন। গবেষক দলের অপর সদস্যরা হলেন একই বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাসলিমা আকতার ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোরশেদা আকতার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মঞ্জুর-ই-আলম। 
 
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় প্রাক-সংক্রমণ প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে ও সংক্রমনকালে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত সংগৃহিত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। আর এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করোনা ভাইরাস এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে করোনা প্রতিরোধে পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চিহ্নিতকরণ, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থা, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ বিস্তার রোধ, করোনা ভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় প্রণোদনা কর্মসূচি, ত্রাণ ও সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি- এই সাতটি বিষয়ে গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক সুশাসনের নির্দেশকের আলোকে গবেষণার আওতাভুক্ত এই বিষয়সমূহকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব নির্দেশক হচ্ছে আইনের শাসন, দ্রুত সাড়াদান, সক্ষমতা ও কার্যকরতা, অংশগ্রহণ ও সমন্বয়, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, এবং অনিয়ম ও দুর্নীতি।
 
গবেষণা প্রতিবেদনের শুরুতেই করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়। যেমন, ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্থগিত করা; মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট ভাষায় একাধিকবার দুর্নীতির ক্ষেত্রে ছাড় না দেওয়ার প্রত্যয়; প্রকাশিত অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে দোষীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ; বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার ঘোষণা; স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা ও স্বাস্থ্য বীমা ঘোষণা; অতি দরিদ্র ৫০ লাখ পরিবারের জন্য নগদ সহায়তা প্রদান; করোনা সংকটকালীন দ্রব্যমূল্য অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল রাখা; এবং জনবল সংকট মোকাবিলায় চিকিৎসক, নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ; ইত্যাদি।
 
গবেষণায় দেখা যায়, করোনা মোকাবিলায় প্রাসঙ্গিক আইন অনুসরণে ঘাটতি আছে, যা আইনের শাসনের বিপরীত। যেমন, ভাইরাসটি মোকাবেলায় ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২’ এবং ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’- এর কোনোটাই যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় নি; ২৩ মার্চ কোভিড-১৯ কে সংক্রামক রোগ হিসেবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও ততদিনে বাংলাদেশে কমিনিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে; স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘সংক্রামক রোগ আইন ২০১৮’ অনুসারে সারাদেশকে ‘সংক্রমিত এলাকা’ বা ‘দুর্গত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা না করে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে ঘোষণা করে – যা মাঠ পর্যায়ে আইনের প্রয়োগ ও লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের ভিত্তিকে দুর্বল করেছে।
 
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় দ্রুত সাড়াদানে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিলম্ব দেখা গেছে। যেমন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কমিটি গঠনে বিলম্ব, সংক্রমণ বিস্তার রোধে বিদেশ হতে আগমন নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ চলাচল ও জন-সমাগম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, পরীক্ষাগার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতিতে বিলম্ব, ত্রাণ ও সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির প্রস্তুতি ইত্যাদি বিষয়ে ঘাটতি দেখা গেছে। আর এসব ক্ষেত্রে বিলম্ব ও ব্যর্থতা সার্বিকভাবে ভাইরাসটির বিস্তাররোধে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
 
গবেষণার তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা অনুপাতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন (মাত্র ০.২৯%) পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষার এ হারের দিক থেকে সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম। পরীক্ষার সুযোগ এখন পর্যন্ত রাজধানীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায় যে মাত্র ৪১.৩ শতাংশ হাসপাতাল নিজ জেলা থেকেই পরীক্ষা করাতে পারে, বাকি ৪৮.৭ শতাংশ হাসপাতালে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার জন্য বিভাগীয় শহরে বা ঢাকায় পাঠাতে হয়। এছাড়া টেকনোলজিস্ট সংকট, মেশিন নষ্ট থাকা, জনবল ও মেশিন সংক্রমিত হওয়া ও সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আবার অজানা কারণে যতটুকু সক্ষমতা আছে ততটুকুও ব্যবহার করা হচ্ছে না বা হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যেমন, বেসরকারী সংস্থা আইসিডিডিআর’বি এর সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হয় নাই।
 
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হাসপাতালগুলোর ৫৩ শতাংশে করোনার প্রভাবে সাধারণ চিকিৎসা সেবায় ব্যাঘাত ঘটছে, যার মধ্যে ৭১ শতাংশ হাসপাতালে নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের কারণে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হচ্ছে বা সেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকছে বলে জানা গেছে। ১১ জুন ২০২০ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) সারাদেশে প্রায় ২৩ লাখ  পিপিই বিতরণ করেছে বলে দাবি করেছে। এই দাবি অনুযায়ী প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীর কমপক্ষে ৩০ সেট সুরক্ষা সামগ্রী পাওয়ার কথা থাকলেও অনেক স্বাস্থ্যকর্মী এখনো একটিও পায় নি বলে হাসপাতাল থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হাসপাতালগুলোর প্রায় ২৫ শতাংশের সকল চিকিৎসক এবং ৩৪ শতাংশের সকল নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী পিপিই পান নি বলে জানিয়েছেন। এছাড়া অধিকাংশ হাসপাতালের (৬৪.৪%) স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মান অনুযায়ী সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ না করার অভিযোগও এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ পিপিই সরবরাহ না করে পৃথকভাবে গাউন, গগলস, সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লাভস, শু-কাভার, হেড কাভার, ফেস শিল্ড সরবরাহ করা হয়।
 
গবেষণায় করোনা ভাইরাস মোকাবিলার বিভিন্ন পর্যায়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫৯ শতাংশ হাসপাতালে নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ২৩ শতাংশ হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ আছে। বাণিজ্যিকভাবে পরীক্ষার অনুমোদন পাওয়া অধিকাংশ বেসরকারি পরীক্ষাগার করোনা পরীক্ষায় সরকার-নির্ধারিত ফি অপেক্ষা অতিরিক্ত ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা আদায় করার অভিযোগ আছে। প্রয়োজনের চেয়ে পরীক্ষাগারের সংখ্যা কম থাকায় অনেকক্ষেত্রে দালালরা ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকায় সিরিয়াল বিক্রি করছে; এমনকি বিভিন্ন প্রয়োজনে ‘করোনা ভাইরাস আক্রান্ত নয়’ এমন সার্টিফিকেট বিক্রি করা হচ্ছে।
 
গবেষণায় চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয়ে ইতোমধ্যে প্রকাশিত দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে জানানো হয়, ত্রাণ ও সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে অনিয়ম-দুর্নীতি দেখা গেছে। গবেষণা এলাকার শতকরা ৮২ ভাগ স্থানে সুবিধাভোগীর তালিকা প্রণয়নে রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ আছে এবং প্রায় ৪২ ভাগ এলাকার ক্ষেত্রে ত্রাণ বিতরণে কোনো তালিকা অনুসরণ না করার অভিযোগ আছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত এলাকার শতভাগ ক্ষেত্রেই অতি দরিদ্রদের নগদ সহায়তা (২,৫০০ টাকা) প্রদানের ক্ষেত্রে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ আছে। ১০ জুন ২০২০ পর্যন্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণে ২১৮টি দুর্নীতির ঘটনায় মোট ৪,৫৯,৮৭০ কেজি ত্রাণের চাল উদ্ধার হয়েছে। এসব দুর্নীতির ঘটনায় ৮৯ জন জনপ্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। গবেষণাভুক্ত এলাকার তথ্য অনুযায়ী, এসব দুর্নীতির ক্ষেত্রে মাত্র ৪ শতাংশ এলাকায় জড়িত সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
 
গবেষণায় করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের স্বচছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির নানা দিক উঠে আসে। যেমন, করোনা চিকিৎসায় বেসরকারি হাসপাতালসমূহের অংশ না নেয়া, এন-৯৫ মাস্ক ক্রয়ে দুর্নীতি, নিম্নমানের পিসিআর মেশিন ক্রয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে দায়ী ও জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। উল্টো সরবরাহকৃত মাস্ক ও সুরক্ষা পোশাকের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলায় চারজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে অনিয়ম দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করা হচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্তের বদলে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারীকে জবাবদিহির আওতায় এনে প্রকারান্তরে দুর্নীতিকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে ঘাটতির পাশাপাশি তথ্য প্রকাশে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এসময় মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণে চুরি ও আত্মসাতের সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশে গণমাধ্যমকর্মীদের বাধা, হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা দেখা গেছে। সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর আওতায় মোট ৬৭টি মামলা দায়ের করা  হয়েছে এবং এই সময়কালে ৩৭ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে কার্টুনিস্ট, সাংবাদিকসহ ৭৯টি ঘটনায় মোট ৮৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
 
উন্নত বিশ্বসহ পৃথিবীর সবদেশেই এই ভাইরাস মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সক্ষমতার ঘাটতি ছিলো উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশ ব্যতিক্রম হবে এটা ভাবা কঠিন ধরে নিয়েও আমরা মনে করি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এই সমস্যাকে যখন জাতীয় দূর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং বিশেষ করে এই সংকট মোকাবেলায় কোন দুর্নীতি সহ্য করা হবে না এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখনই সবাইকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সুশাসন নিশ্চিত করে এই সংকট সফলভাবে প্রতিরোধের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ গবেষণায় দেখতে পেয়েছি ভাইরাসটি মোকাবিলায় গৃহিত নানা পদক্ষেপে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকেই ব্যাপক ঘাটতি ছিলো; তদুপরি দুর্নীতি হয়েছে উদ্বেগজনকভাবে। জীবন এবং জীবিকার দ্বন্দে শুরু থেকেই আমরা দেখেছি- অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখার বিষয়টিকে যৌক্তিকভাবে প্রাধান্য দেয়া হলেও সেখানে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ছিলো না। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহল থেকে ভাইরাসটি মোকাবিলায় বারবার সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্বের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হলেও ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী মহলের চাপে এক্ষেত্রে সরকারী সিদ্ধান্ত অকার্যকর করে দেয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে অবমূল্যায়নকারী ও বিভ্রান্তিকর বার্তা দেয়া হয়েছে; এতে করে দেশে ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়েছে।”
 
সংকট মোকাবিলায় গৃহীত উদ্যোগকে পুঁজি করে অনেকেই নিজেদের সম্পদ বিকাশের জন্য যোগসাজশমূলক দুর্নীতির সুযোগ হিসেবে দেখেছেন মন্তব্য করে ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, “করোনা মোকাবিলার নানা পর্যায়ে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারির পরও যারা অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের বিচার না হওয়ায় প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত, এর ফলে যারা সুবিধাভোগী, যোগসাজশকারী কিংবা যারা সুরক্ষাকারী তারা কি আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী, সরকার তথা সরকারি দলের মানহানি করছেন না? এদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না কেন?” তিনি বলেন, “দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোন ম্যাজিক বুলেটের প্রয়োজন নেই। যারা দুর্নীতি করেন তারা কর্তৃপক্ষের জানাশোনার বাইরে নন। তাদেরকে চিহ্নিত করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় কার্যকর জবাবদিহি নিশ্চিত করলেই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ঘোষণা বাস্তবায়ন সম্ভব।” এসময় তিনি সংকট মোকাবিলায় তথ্য ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ করে তথ্য প্রকাশ আর মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করা নয়, জনগন চায় সংকট মোকাবেলায় সকল প্রকার দুর্নীতি ও অনিয়মের নিয়ন্ত্রণ।
 
এই গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে টিআইবি ১৫ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো- সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ও জনবলের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা জেলা পর্যায়ে আরও সম্প্রসারণ করতে হবে এবং বিদ্যমান সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে; স্বাস্থ্য খাতে জেলা পর্যায়ে সার্বিকভাবে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে (জিডিপির ৫%); সকল পর্যায়ের হাসপাতালে স্ক্রিনিং ও ট্রায়াল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সম্মুখ সারির সকল স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মানসম্মত সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে; সমন্বিত চিকিৎসার প্রয়োজনে সকল বেসরকারি হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে; সকল হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসার পাশাপাশি অন্যান্য রোগের নিয়মিত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে; ত্রাণ ও সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের তালিকা হালনাগাদ করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে; তথ্য প্রকাশ এবং তথ্যে প্রবেশগম্যতার সুবিধার্থে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের স্বার্থে গণমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে; ত্রাণ বিষয়ক দুর্নীতির সাথে জড়িত সাময়িক বরখাস্তকৃত জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; ইত্যাদি।

আপনার মতামত লিখুন :

নিজস্ব প্রতিবেদক। ডেক্স