প্রবন্ধ: “কবিতার ছন্দ কথা”

প্রকাশিত: ৯:৫০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২০, ২০২০ | আপডেট: ৯:৫০:অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২০, ২০২০
কবিতার ছন্দ কথা
            রুদ্র অয়ন 
 
কবিতা কেবল মাত্র অনুভবের স্টেটমেন্ট নয়। অনুভবকে পাঠকের মন ও মননে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্বও সে পালন করে। 
আমি এখানে কবিতার ছন্দ সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। ছন্দের প্রসঙ্গ আসতেই  মনে পড়ে গেলো কিছু তিড়িং বিড়িং জ্ঞান গরিমার লেখকের কথা। যারা ভাল লেখকের লেখা পড়েনওনা, ভাল লেখকের লেখনী ষ্টাইল বুঝেনওনা আর লেখালেখি প্রসঙ্গে বিখ্যাত লেখকদের আলোচনাও পড়েননা কখনও। নিজের খেয়াল খুশিতে ছন্দ অছন্দের খিচুড়ি পাকিয়ে লিখেন! কাউকে আঘাত করা আমার কর্ম নয় তবে কারও কারও কান্ডজ্ঞানহীন আচরণের কারণেই বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে। ক’দিন আগে হঠাৎ একজনের প্রোফাইলে গিয়ে দেখি তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন ‘দু’ই বাংলার জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবি’ ভাবখানা এমন যে রবীন্দ্র, নজরুল, সুকুমারদের বাংলায় জন্মই হয়নি অথবা হুমায়ুন, সুনিল, নিরেন্দ্র, শীর্ষেন্দু এঁরাও বাংলায় আসেননি!
 টাস্কি খেয়ে প্রোফাইল ঘেঁটে দেখি লেখার মাঝে শব্দ শৈলিতো তেমন নাই-ই, ছন্দ প্রয়োগের জ্ঞানটাও অনুপস্থিত।  দু’একটা অনলাইন পত্রিকায় লিখেছেন বটে, লাইভেও কি সব বলেছেন তবে তিন দিনে তিনটার বেশি লাইক পাননি আর কমেন্টও নেই। এই তার জনপ্রিয়তার, প্রসিদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ! কয়দিন আগে কথা হলো ওপার বাংলার জনসমাদৃত পত্রিকা আনন্দবাজার সাহিত্য সম্পাদকের সাথে। সেই বিখ্যাত লেখকের নাম করে বলি, আচ্ছা আপনার পত্রিকায় ওমুকের লেখা ছাপা হয়না কেন?
শ্রদ্ধেয় সম্পাদক বললেন,আনন্দ সাহিত্য কোনও পাগলের খোঁয়াড় নয়।
হ্যাঁ,আমি জানি আনন্দ বাজার সাহিত্য পাতায় ফালতু কারও লেখা স্থান পায়না। আর এও জানি আনন্দ বাজার পত্রিকায় লেখা মানেই লেখকের ভেতর কিছু লেখকী মাল থাকা। পরম শ্রদ্ধেয়, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় আমাকে বিশেষ সংখ্যাগুলোতে লেখার আহবান জানালেন। আমি সবিনয়ে সম্মান জানিয়ে সেদিনের মত আলাপের যবনিকাপতন ঘটালাম। কারও প্রতি আমার অভক্তি বা অসম্মান নেই। শুধু বলতে চাই, নিজের খেয়ালখুশি মত বক্তব্য লিখে দিলেই কবিতা হয়ে যায়না। আর নিজেকে বিখ্যাত ঘোষণা করলেই বিখ্যাত হওয়া যায়না। শিক্ষার মাল থাকতে হয়। নিজের লেখার ভুলত্রুটি খুঁতিয়ে দেখার মত বিচক্ষণতা থাকা লাগে। বিখ্যাত লেখকের লেখার ষ্টাইলের লেখা নিজের লেখার মান বিবেচনা করা শিখতে হয়। পড়তে হয়, জানতে হয়, শিখতে হয়। একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী বলেছিলেন, জ্ঞানের মহাসাগরে এসে নুড়ি কুড়োচ্ছিমাত্র! সেখানে আমিতো কোন ছাড়। যাকগে এবার মূল আলোচনায় আসা যাক।
আমি এখানে কবিতার ছন্দ নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করবো। 
যদিও গদ্য কবিতা / গদ্যছন্দ বলে এক শ্রেণীর কবিতা আছে, এবং সমর সেন সহ অনেক বিখ্যাত কবিই গদ্য ছন্দে লিখেছেন, গদ্য কবিতা নয় আমি এখানে ছন্দ কবিতা নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি ছন্দের প্রয়োজন কখনো ফুরোয়নি আর ফুরোবেও না। কবিতায় আমরা যে দোলা বা স্পন্দের কথা বলি তা এই ছন্দ থেকেই আসে। অনেকে ছন্দকে বন্ধন মনে করে বন্ধনমুক্তিতে বিশ্বাসী। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি-রবীন্দ্রনাথ সেতারের উদাহরন দিয়েছিলেন। সেতারের তারের বন্ধনেই সুরের মুক্তি। বন্ধনে মুক্তি অদ্ভুত শোনালেও চূড়ান্ত মুক্তি মানে বিশৃঙ্খলা। ছন্দে লিখুন বা না-ই লিখুন, জেনে রাখাটা দরকার। এটা কোনও একাডেমিক আলোচনা না, কেবল একটা সহজ গাইড উদাহরণ আলোচনা মাত্র।
 
ছন্দ তিন প্রকার: 
বাংলা কবিতার ছন্দকে মোটামুটি তিন ধরনের বলে ধরে নেয়া হয়; 
স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত। 
মাত্রাবিচারের রীতিভেদে ছন্দও পাল্টে যায়। 
মাত্রা কাকে বলে? 
সোজা কথাই মাত্রা মানে পরিমাপক অর্থাৎ ইউনিট অফ মেজার। জল মাপি লিটারে, কাপড় মাপি মিটারে আর ছন্দ মাপি মাত্রায়। কবিতার এক-একটি পংক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে, এবং তাকে উচ্চারন করার জন্য মোট যে সময় আমরা নিয়ে থাকি, সেই উচ্চারনকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটা অংশই হল মাত্রা। প্রবোধচন্দ্র সেন তারই নাম দিয়েছেন কলা। কলা মানে এখানে অংশ। ষোল কলায় যেভাবে চাঁদ পূর্ণ হয়, তেমনি কলা বা মাত্রার সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় পূর্ণ এক-একটি পংক্তি (লাইন) উচ্চারনকাল। 
কঠিন লাগছে? আরো সোজা ভাবেই মাত্রাবিচারের পদ্ধতি নিচে আলোচনা করবো।
 
স্বরবৃত্ত ছন্দ
যে ছন্দ পাঠকালে, উচ্চারন গতিবেগ দ্রুত হয়, শ্বাসঘাত পরে, 
পর্বগুলো হয় ছোট কেবল ৪ মাত্রার এবং যে ছন্দে অক্ষর 
মানেই ১ মাত্রা ধরা হয়, তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলে। 
স্বরবৃত্ত ছন্দ জানতে হলে, তার আগে অক্ষর, পর্ব, মাত্রা, 
যতি বা ছন্দ-যতি, ও শ্বাসঘাত জানা জরুরী। 
****মুক্তাক্ষর ও বদ্বাক্ষরঃ যখন একটি অক্ষরে একটিই বর্ণ থাকে 
এবং উচ্চারনে বাধাগ্রস্থ্য হয়না, তখন তাকে মুক্তাক্ষর বলে। 
যেমন – কলম= ক + লম। এখানে ” ক ” হচ্ছে মুক্তাক্ষর। 
যদি একাধিক বর্ণ মিলে একটি অক্ষর বুঝায়, তাকে বদ্ধাক্ষর বলে। 
যেমন- 
কলম = ক + লম। এখানে ” লম” হচ্ছে বদ্ধাক্ষর। 
**** অক্ষরঃ স্বল্পতম প্রয়াসে এক ঝোঁকে শব্দের যে 
অংশতুকু উচ্চারিত হয়, তাকে অক্ষর বলে। যেমনঃ 
কলম = ক + লম = ২ অক্ষর। 
চিরজীবি = চি + র +জী + বি = ৪ অক্ষর। 
**** মাত্রাঃ কবিতার প্রতি পংক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে, এবং 
তাকে উচ্চারনে যে সমইয়ের প্রয়োজন হয়, সেই 
উচ্চারনকালের ছোটো ছোট এক-একটা অংশই হল মাত্রা। 
বাংলা সাহিত্যে এই মাত্রা সংখ্যা একেক ছন্দে একেক রকম 
ব্যবহৃত হয়। 
শ্বাসঘাতঃ কবিতা পাঠের সময়, পর্বের প্রথম অক্ষরের 
উপর জোর দিয়ে পাঠ করাকেই শ্বাসঘাত বলে। যেমন- 
মা কেঁদে কয় / মঞ্জুলী মোর / ঐ তো কচি / মেয়ে = 
৪+৪+৪+২ মাত্রা 
এখানে ( মা – মন – ঐ ) ৩ টি পর্বের প্রথম অক্ষরে জোর 
পরে বেশি। 
যতি বা ছন্দ-যতিঃ কোন বাক্য পড়ার সময় শ্বাসগ্রহণের 
সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের অন্তর অন্তর যে উচ্চারণ বিরতি 
নেয়া হয়, তাকে ছন্দ-যতি বা শ্বাস-যতি বলে। 
যতি ২ প্রকার- হ্রস্ব যতি ও দীর্ঘ যতি। অল্পক্ষণ বিরতির জন্য 
বাক্যের মাঝখানে হ্রস্ব যতি দেওয়া হয়। এবং বেশিক্ষণ বিরতির 
জন্য বাক্যের দীর্ঘ যতি ব্যবহৃত হয়। 
যেমনঃ- কলস নিয়ে ∣ সবাই তখন ∣ পাড়ায় গেছে ∣ চলে ∣∣ 
এখানে, কলস নিয়ের পর হ্রস্ব যতি, সবাই তখনের পর হ্রস্ব 
যতি, পাড়ায় গেছে এর পর হ্রস্ব যতি। । পরেছে। 
আবার, কলস নিয়ে সবাই তখন পাড়ায় গেছে চলে পুরা 
লাইন্টার পর দীর্ঘ যতি পরেছেম। 
( ∣ = হ্রস্ব যতি ও ∣∣ = দীর্ঘ যতি) 
****পর্বঃ বাক্য বা পদের এক হ্রস্ব যতি হতে আরেক হ্রস্ব 
যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলা হয়। যেমনঃ 
কলস নিয়ে ∣ সবাই তখন ∣ পাড়ায় গেছে ∣ চলে ∣ 
এখানে একটি চরনে মোট ৪টি পর্ব। ৩টি মুল পর্ব। ১টি 
অতিপর্ব। 
 
এখন আসুন স্বরবৃত্ত ছন্দের গঠন আলোচনা করিঃ 
স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্যঃ 
– স্বরবৃত্তের মূল বিষয়টিই আবর্তিত হয় দুটি সিলেবল বা 
দলকে (মুক্ত ও বদ্ধ দল) ঘিরে। 
– স্বরবৃত্ত দ্রুত লয়ের ছন্দ। 
– এই ছন্দের মূলপর্ব বা পূর্ণপর্ব চার মাত্রাবিশিষ্ট। 
– মুক্তাক্ষর এবং বদ্ধাক্ষর উভয়ই একমাত্রা বিশিষ্ট। 
– পর্বগুলো ছোট ৪ মাত্রা বিশিষ্ট। 
– প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষর শ্বাসাঘাতযুক্ত। 
উদারহনঃ 
বাঁ শ বাগানের ∣ মা থার উপর ∣ চাঁ দ উঠেছে ∣ ও ই ∣∣ 
এখানে – 
~~বাঁশ-১ মাত্রা + বা – ১ মাত্রা + গা – ১ মাত্রা + নের – ১ মাত্রা = ৪ 
মাত্রা এবং ৪ অক্ষর। 
~~ বাঁশ বাগানের ∣ মাথার উপর ∣ চাঁদ উঠেছে ∣ ওই ∣∣ = 
৪+৪+৪+১ মাত্রার ৪টি পর্ব। 
~~ বাঁ – মা – চাঁ – ও প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষরটি উচ্চারনের 
সময় শ্বাসঘাত পরে।
 
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
বাংলা কবিতার খুবই বনেদি ছন্দ। রবীন্দ্রনাথের আগে, রবীন্দ্র কাব্যের সূচনাপর্বেও বাংলা কবিতা প্রধানত অক্ষরবৃত্তেই লেখা হয়েছে, এবং বিস্ময়করভাবে এখন পর্যন্ত অক্ষরবৃত্ত তার শীর্ষ আসন ধরে রেখেছে। 
জীবনানন্দের গ্রণ্হভূক্ত কবিতার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো। এই মোট ৩৫২টি কবিতার ২৭৫টি অক্ষরবৃত্তে, মাত্রাবৃত্তে ১৬টি, স্বরবৃত্তে ৩৭টি এবং গদ্যছন্দে ২৪টি। ভেবে জীবনানন্দের গ্রণ্হভূক্ত কবিতার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো। এই মোট ৩৫২টি কবিতার ২৭৫টি অক্ষরবৃত্তে, মাত্রাবৃত্তে ১৬টি, স্বরবৃত্তে ৩৭টি এবং গদ্যছন্দে ২৪টি। ভেবে দেখুন! 
আমার জানা মতে বিনয় মজুমদার তাঁর সমস্ত কবিতা অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন (উনি অবশ্য পয়ার বলতেন)। আমারতো মনে হয়, একজন কবি শুধু অক্ষরবৃত্তে লিখেই কবিজীবন পার করে দিতে পারেন। 
অক্ষরবৃত্তের মাত্রাগণনা 
অক্ষরবৃত্তের লক্ষণ কী? লক্ষণ মোটামুটি এই যে, এ ছন্দে যত অক্ষর বা বর্ণ, তত মাত্রা অর্থাৎ কিনা প্রতিটি অক্ষরই এখানে ১টি মাত্রার মর্যাদা পেয়ে থাকে, যেমন- 
১/ শ্যামল সুন্দর প্রভু কমললোচন (১৪ মাত্রা -গুণে দেখুন) 
২/ পোড়া প্রণয়ের বুঝি জরামৃত্যু নাই (১৪ মাত্রা) 
বিনয় মজুমদারের সহজ ফর্মুলা- 
“বাংলা অক্ষরের উপরে যে মাত্রা দেয়া আছে আমি তাকেই মাত্রা বলি। যথা, ‘অ’ অক্ষরের উপরমাত্রা দেয়া আছে, সুতরাং অ অক্ষরে একটি মাত্রা। ‘ত’ অক্ষরে মাত্রা দেয়া আছে সুতরাং ত অক্ষরে একটি মাত্রা। ‘স্ক’ ‘ল্ল’ ইত্যাদিতেও একটি মাত্রা। অর্থাৎ অক্ষরবৃত্তে যুক্তাক্ষরেও একটিই মাত্রা। ‘ৎ’ তে মাত্রা নেই, তাই ‘উৎফুল্ল’ অক্ষরবৃত্তে ৩ মাত্রা, ‘হঠাৎ’ ২ মাত্রা। তিনটি অক্ষরও যদি যুক্ত থাকে যেমন ‘উজ্জ্বলে’ –‘জ্জ্ব’ কে এক মাত্রা গণনা করে মোট ৩ মাত্রা হবে। ” 
এটাই নির্ভুল ও প্রাথমিক নিয়ম। অবশ্য এর পরেও অল্প কিছু ছোটো নিয়ম আছে। 
স্বরবর্ণে ‘এ’ অক্ষরে, ‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই। কিন্তু ‘এ’ অক্ষরে সর্বদাই এক মাত্রা ধরতে হবে, যেমন ‘এসো’ ২ মাত্রা। ‘এখন’ ৩ মাত্রা। 
‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই। তবে অধিকাংশ শব্দেই ‘ও’ অক্ষরে একমাত্রা ধরতে হবে। অল্প কয়েকটি শব্দে ‘ও’ অক্ষরে শূন্য মাত্রা। ‘ওঠ’ ২ মাত্রা, কিন্তু ‘হাওয়া’, ‘যাওয়া’, ‘খাওয়া’, ‘চাওয়া (অর্থাৎ- শব্দের শেষে ‘ওয়া’ থাকলে) ‘ও’ শূন্য মাত্রা। এগুলোকে ২ মাত্রা বলেই গণ্য করতে হবে। ” 
*(কেন করতে হবে সে বিশদ ব্যাখ্যাই না গিয়ে কেবল এই শব্দগুলো মনে রাখতে বলছি ) 
“এবার ব্যঞ্জনবর্ণ। ব্যঞ্জনবর্ণে প্রকৃতপ্রস্তাবে ‘ঙ’ এবং ‘ৎ’ – এই দুটি অক্ষরের উপরে মাত্রা আঁকা হয়না। বাঙ্ময়, কঙ্কাল, অঙ্ক এবং অনুরূপ সব শব্দে ‘ঙ’ অক্ষরের সঙ্গে অন্য অক্ষর যুক্ত হয়ে যুক্তাক্ষর তৈরি হবার ফলে এই যুক্তাক্ষরে এক মাত্রা। অর্থাৎ ‘কঙ্কাল ‘ ৩ মাত্রা, ‘অঙ্ক’ ২ “এবার ব্যঞ্জনবর্ণ। ব্যঞ্জনবর্ণে প্রকৃতপ্রস্তাবে ‘ঙ’ এবং ‘ৎ’ – এই দুটি অক্ষরের উপরে মাত্রা আঁকা হয়না। বাঙ্ময়, কঙ্কাল, অঙ্ক এবং অনুরূপ সব শব্দে ‘ঙ’ অক্ষরের সঙ্গে অন্য অক্ষর যুক্ত হয়ে যুক্তাক্ষর তৈরি হবার ফলে এই যুক্তাক্ষরে এক মাত্রা। অর্থাৎ ‘কঙ্কাল ‘ ৩ মাত্রা, ‘অঙ্ক’ ২ মাত্রা। 
তবে শব্দের শেষে ‘ঙ’ থাকলে ‘ঙ’ অক্ষরে সর্বদাই একমাত্রা ধরতে হবে। যেমন- ‘রঙ’ ২ মাত্রা। 
‘ৎ’ শব্দের মাঝে থাকলে শূন্যমাত্রা। যেমন ‘উৎপ্রেক্ষা’ ৩ মাত্রা। আবার শব্দের শেষে থাকলে ‘ৎ’ ১ মাত্রা দাবি করে, যেমন ‘প্রদোৎ’ ৩ মাত্রা, ‘হঠাৎ’ ৩ মাত্রা। ” 
মাত্রা গণনার নিয়মাবলী এখানে সমাপ্ত করছি। 
আমরা অক্ষরবৃত্তে মাত্রা গণনার নিয়ম আলোচনা করেছি। এবারে একটি পংক্তিতে (লাইনে) কয় মাত্রা বসানো যায় সেকথা বলছি। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চাল আসলে ৪ মাত্রার চাল। প্রতিটি পর্বে (অংশে) থাকে ৪টি মাত্রা, শেষে থাকে ২ মাত্রার ভাঙা পর্ব। সোজা কথায় অক্ষরবৃত্তে মাত্রাসংখ্যার ফর্মুলা হচ্ছে ৪ এর গুণিতক +২। 
যেমন: 
৪ x ১ +২ = ৬ 
৪ x ২ + ২ = ১০ 
৪ x ৩ + ২ = ১৪ 
এই নিয়মে ১৮, ২২, ২৬, ৩০ এভাবে মাত্রাসংখ্যা হতে পারে। অবশ্য অত বড়ো লাইন কেবল জীবনানন্দ দাশই লিখে গেছেন। 
*৬ মাত্রার পংক্তি ভেঙে দেখাই – 
খেলাঘর / ভাঙে ঝড়ের আ / ঘাতে। 
*১০ মাত্রা ভেঙে দেখাই – মুখ নেই, / লোভ ফুটে / আছে; শিকারীর / সহজ উ / দ্যম নিরঙ্কুশ / সফলতা / আছে। 
*১৪ মাত্রা ভেঙে দেখাচ্ছি – 
সহসাই / ফুঁসে ওঠে / কুলীন গো / ক্ষুর অন্ধ রোষে / বিষ ঢালে / নরম মা/ টিতে। 
* ১৮ মাত্রার উদাহরন— 
বজ্রের উ / ল্লাসে খোলে / বৃক্ষদের / তৃষ্ণার দ / রোজা। 
*২২ মাত্রার উদাহরন বিনয় মজুমদারের কবিতা থেকে – 
সুদূর স / মূদ্রজলে / একটি গী / টার ভেসে / চলেছে এ / খন 
যখন স / কলে ডুবে / নিশ্চিহ্ন হ / য়েছে / সব হারিয়ে গি / য়েছে। 
আর উদাহরন বাড়াবো না। আপনারা ২৬ মাত্রা এমনকি ৩০ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে নিজেরাই খুঁজে বের করুন। 
আরো কিছু জরুরী কৌশল 
এভাবে ৪ মাত্রা করে লিখতে গেলে পাগল হয়ে যাবেন। তাই সহজ কায়দা হলো- দুটো মহাপর্বে লাইনটাকে ভাগ করে নেয়া। প্রথম মহাপর্বে থাকবে ৮মাত্রা, বাকি মাত্রাগুলো পরের মহাপর্বে। অর্থাৎ ভাঙতে হবে নিচের নিয়মে। 
(*৬ মাত্রা এভাবে ভাঙার কিছু নেই ) 
১০ মাত্রা=৮+২ 
১৪ মাত্রা= ৮+৬ 
১৮ মাত্রা+৮+১০ 
২২ মাত্রা=৮+১৪ 
এইভাবে বাকিগুলো আপনারা ভেঙে নিন। 
এই নিয়মে ভাঙলে লাইনের নতুন চেহারা হবে– 
সম্রাজ্ঞীর মতো চোখে / তার খেলা করে 
অযুত গোলাপ, আর / পাতক কীটেরা 
কুরে কুরে খায় সেই / চোখের ঐশ্বর্য 
তীব্র হিমে ক্ষয়ে যায় / ফুলের প্রতিভা। 
এরপরে সবচে’ জরুরী কথা হচ্ছে, প্রথম ৮ মাত্রার মহাপর্বকে না ভাঙার চেষ্টা করবেন। যেমন এভাবে ভাঙবেন না – 
তোমাদের এখানে পা / হাড়ী ঝর্ণা আছে? 
*এভাবে ভাঙলে একবারে অশুদ্ধ হবেনা, তবে পাঠকের পড়তে কষ্ট হবে। তাই যতটা সম্ভব ৮ মাত্রার প্রথম মহাপর্বকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চেষ্টা করবেন। 
অক্ষরবৃত্তের আরো কিছু নিয়ম 
শব্দের পরে শব্দ গাঁথারও একটা নিয়ম আছে। ছন্দের জাদুকর নামে খ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একটা সোজা কথা বলে দিয়েছেন– বিজোড়ে বিজোড় গাঁথো, জোড়ে গাঁথো জোড়। 
অর্থাৎ বিজোড় শব্দের সাথে বিজোড় শব্দ এবং জোড় শব্দের সাথে জোড় শব্দ ব্যবহার করবেন। কেন করবেন? কারন তাহলে পাঠকের কান আহত হয়না। 
কখনো নিচের নিয়মে সাজাবেন না– 
৩+২+৩, ৫+২+১, ২+৩+৩, কেউ কেউ অবশ্য ৫+৩ ও নিষেধ করেন। অবশ্য ৩+৫ ঠিক আছে। 
আপাতত অক্ষরবৃত্তের নিয়মের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। এটুকু আস্তে আস্তে অনুশীলন করুন। 
জরুরী একটা ভুলে বসে আছি। এখন অক্ষরবৃত্ত বেশির ভাগই অমিল মুক্তকে লেখা হয়। অমিল তো বুঝতেই পারছেন অন্ত্যমিল নেই (অবশ্য অন্ত্যমিলেও দারুণ কবিতা লেখা যায়), আর মুক্তক মানে বিভিন্ন লাইনের বিভিন্ন দৈর্ঘ্য হতে পারে একই কবিতায়। যেমন এক লাইনে ১৪, আবার পরের লাইনে ১০, তারপর আবার ৬ কিংবা ১৮, কবির প্রয়োজনে।
 
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
ভূমিকা: 
আমরা অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনা মোটামুটি শেষ করেছি। এবারে আমরা মাত্রাবৃত্ত নিয়ে কথা বলবো। প্রথমেই বলে নিই, এই পদ্ধতি অ্যাকাডেমিক পদ্ধতির থেকে ভিন্নতর। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছন্দ শেখার যে সহজ ফর্মুলা দিয়েছেন তা থেকেই মূলত আমি আমার মতো করে সংক্ষেপে মাত্রাবৃত্তের নিয়মগুলো তুলে দিচ্ছি। তবে এও বলে রাখি- স্বরবৃত্ত ছন্দের ক্ষেত্রে কিন্তু এইসব সহজ ফর্মুলায় চলবেনা, সেক্ষেত্রে সিলেবল বা দল (মুক্তদল ও রুদ্ধদল) দিয়েই মাত্রার হিসাব করতে হবে। ওখানে আর অক্ষর দিয়ে হিসাবের সহজ কায়দা চলবেনা। সিলেবল হচ্ছে উচ্চারণের এক-একটি ইউনিট বা একক। অর্থাৎ স্বরবৃত্তে আর চোখের হিসাব চলবেনা, কানের বিচারে চলতে হবে বেশি করে। 
আমি সহজ ফর্মুলার লোক, তাই মাত্রাবৃত্ত পর্যন্ত গিয়েই থেমে যাব। স্বরবৃত্ত নিয়ে যেহেতু নতুন কায়দা খুঁজে পাইনি, সেহেতু ওটা নিয়ে আপাতত আলচনা করছি না। আমার উদ্দেশ্য নিশ্চয় বুঝতে পারছেন? বাংলা কবিতার প্রধান ৩ ছন্দের মধ্যে যদি ২টি ছন্দের সোজা পদ্ধতি যদি আমরা জেনে নিতে পারি, আর কী চাই? 
বাংলা কবিতার সিংহভাগ এখনো এই দুটো ছন্দেই লেখা হয়। ছড়ার ছন্দটি স্বরবৃত্তের, ওটা আপাতত আলোচনা করছি না- তবে স্বরবৃত্তে জীবনানন্দ দাশসহ অনেক কবিই সার্থক কবিতা লিখেছেন। 
মাত্রাবৃত্তে মাত্রা গণনা: 
অক্ষরবৃত্তে আমরা মোটের ওপর (কিছু ব্যতিক্রম আগেই উল্লেখ করেছি) যত অক্ষর তত মাত্রা এই ফর্মুলায় চলেছি। যুক্তাক্ষরকেও এখানে আমরা ১ মাত্রা দিয়েছি। তবে মাত্রাবৃত্তে যুক্তাক্ষরকে কিন্তু পূর্ণ মূল্য দিতে হবে, অর্থাৎ ২ মাত্রা দিতে হবে। অনেকেই তাই মাত্রাবৃত্তকে ‘যুক্তাক্ষর ভাঙা ছন্দ’ বলে অভিহিত করেন। একটা উদাহরন দেই–‘কষ্ট ’ শব্দটি অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা, কিন্তু মাত্রাবৃত্তে ভেঙে গিয়ে হবে ‘ক ষ্ ট’ – ৩ মাত্রা। বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়? আরেকটা বলি- ‘ছন্দ’ অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা, আর মাত্রাবৃত্তে ৩ মাত্রা (ছ ন্ দ )। 
তবে এখানেও একটা ব্যতিক্রম মনে রাখতে হবে। তা হচ্ছে শব্দের প্রথমে কোন যুক্তাক্ষর থাকলে সেটা ভাঙা সম্ভব নয়, সে কারনে মাত্রাবৃত্তেও সে ১ মাত্রাই পাবে। বোঝেন নি? ধরুন ‘ক্লাস’ শব্দটি। এটি কিন্তু অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত দুই ছন্দেই ২ মাত্রা পাবে। কারণ শব্দের শুরুতেই যুক্তাক্ষর ‘ক্ল’ কে ভাঙা যাচ্ছেনা। 
তাহলে সোজা কথায় আমরা জানলাম- শব্দের মাঝখানে অথবা শেষের যুক্তাক্ষরকে আমরা মাত্রাবৃত্তে ২ মাত্রার মর্যাদা দেব, আবারও বলি শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে ১ মাত্রা-ই দেব। 
রবীন্দ্রনাথই এই ছন্দের স্রষ্টা। ‘মানসী’ পর্বের কবিতা থেকেই এই ছন্দের সূচনা। ‘মানসী’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি। ” বোঝাই যায়, এখানে পূর্ণ মূল্য বলতে ২ মাত্রার মূল্য। 
যুক্তাক্ষরের বাড়তি বোঝা নিয়ে অক্ষরবৃত্ত যদি হাতির চালে চলে, মাত্রাবৃত্ত চলে তেজী ঘোড়ার মতো। 
অক্ষরবৃত্ত জোড়া দিতে চায়, মাত্রাবৃত্ত চায় ভাঙতে। 
মাত্রাবৃত্তের নানারকম চাল 
আমরা অক্ষরবৃত্তকে দেখেছি ৪ এর চালে চলতে। এর লাইন তৈরি করেছি ৪ এর গুণিতক + ২ দিয়ে। এখানে মাত্রাসংখ্যা সব সময় আমরা ৪ যোগ করে বাড়িয়েছি, যেমন- ৬, ১০, ১৪, ১৮, ২২ – মনে আছে নিশ্চয়? কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন করতে পারেন ওখানে আবার +২ কেন বাপু? এরও কারন আছে, ছন্দোগুরুরা এমনি এমনি এই বাড়তি ২ মাত্রা সবখানে রাখেননি। কবিতা পড়তে পড়তে একটু দম ফেলার অবকাশ চাই, একটানা ছুটতে গেলে নাভিশ্বাস উঠে যেত। ঐ ২ মাত্রাতেই সেই দম ফেলার জায়গা। 
বাড়তি ২ মাত্রা না থাকলে এ রকম হতো: 
বাজে লক্ষ ঢাকঢোল 
চতুর্দিকে হট্টগোল। 
আর সহ্য হয় কত, 
প্রাণ হল ওষ্ঠাগত। 
ভক্তেরা বিষম খান, 
দলে দলে মূর্ছা যান। 
–দাঁড়ি-কমা থাকা সত্ত্বেও লাইনের শেষে দাঁড়ানো যাচ্ছেনা। ছন্দের তাড়না প্রবল হয়ে পাঠককে পাগলের মতো ছুটিয়ে মারছে। 
অক্ষরবৃত্তের চাল কেবল ৪ মাত্রার চাল, তবে মাত্রাবৃত্তের চাল কিন্তু এক ধরনের নয়। হ্যাঁ, মাত্রাবৃত্ত নানান চালে চলে। 
এখানে অক্ষরবৃত্তের মতো ৪ মাত্রার চালের পাশাপাশি ৫ মাত্রার চাল, ৬ মাত্রার চাল, আর ৭ মাত্রার চাল আছে। 
লাইনের এক-একটা অংশে বা পর্বে মাত্রাসংখ্যা দিয়েই আমরা বিচার করবো, কোনটা কত মাত্রার চাল। কঠিন লাগছে? আরে ভাই, উদাহরন দিতে শুরু করলে দেখবেন পানির মতো! 
মাত্রাবৃত্তে ৪ মাত্রার চাল 
একটা বানিয়ে ফেলি— 
নির্জন রাত্রিতে কাকে তুমি ডাকো ? 
কান্নার জল দিয়ে কার ছবি আঁকো! 
ভেঙে দেখাই— 
নির্জন / রাত্রিতে / কাকে তুমি / ডাকো ? 
কান্নার / জল দিয়ে / কার ছবি / আঁকো? 
(এখানে নির্জন = নি র্ জ ন, রাত্রিতে = রা ত্ রি তে, কান্নার = কা ন্ না র) 
*এখানে কী দেখছি? ৩ টে করে ৪ মাত্রার পর্ব (অংশ) প্রত্যেক লাইনে, শেষে একটা ২ মাত্রার ভাঙা পর্ব। ভাঙা বলছি এ জন্য যে, এটি ৪ মাত্রার তো আর নয়। 
যাহোক, মাত্রাবৃত্তে এই ভাঙা পর্ব আপনি রাখতেও পারেন, নাও পারেন। ভাঙা পর্বের মাত্রাসংখ্যা ১, ২ বা ৩ – আপনার ইচ্ছেমতো রাখতে পারেন। 
আরেকটা উদাহরন তৈরি করা যাক– 
অস্ফুটে বলেছে সে কী, 
আমি তার কিছু শুনিনি। 
*ভেঙে দেখি চেহারাটা– 
অস্ফুটে / বলেছে সে / কী, 
আমি তার / কিছু শুনি / নি 
** অস্ফুটে (অ স্ ফু টে – ৪ মাত্রা)। এখানে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক লাইনে ২টা করে ৪ মাত্রার পর্ব, আর একটি করে ১ মাত্রার ভাঙা পর্ব। 
তাহলে বোঝা গেল প্রতি লাইনে পর্বের সংখ্যা আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। ভাঙা পর্বেও বৈচিত্র্য আনতে পারেন। ইচ্ছে করলে প্রতিটি লাইন শেষে একই মাত্রার আবার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার ভাঙা পর্ব রাখতে পারেন (১, ২, ৩),আবার নাও রাখতে পারেন। 
আর একটা কথা- অন্ত্যমিল রাখা না রাখাও কিন্তু আপনার ব্যাপার। 
মাত্রাবৃত্তে ৫ মাত্রার ছন্দ 
এবারে ৫ মাত্রার কিছু দৃষ্টান্ত দেয়া যাক- 
তোমার চোখে কিসের ছায়া গভীর কালো? 
ছিন্ন পাতা ঝরে পড়ছে হাওয়ার হাতে; 
কোথাও যেন মেঘ জমেছে বিষণ্নতার 
কেউ জানেনা কারনটা কী মন খারাপের। 
পর্ব হিসাবে ভাঙলে এ রকম দাঁড়াবে: 
তোমার চোখে / কিসের ছায়া / গভীর কালো?
ছিন্ন পাতা / ঝরে পড়ছে / হাওয়ার হা / তে; 
কোথাও যেন / মেঘ জমেছে / বিষণ্নতা / র 
কেউ জানেনা / কারনটা কী / মন খারাপে / র। 
* প্রতি লাইনে ৫ মাত্রার ৩টি করে পর্ব। প্রথম লাইনে ভাঙা পর্ব নেই। অন্যগুলোতে ১ মাত্রার ভাঙা পর্ব। (ছিন্ন = ছি ন্ ন / ৩ মাত্রা, বিষণ্নতা = বি ষ ণ্ ন তা / ৫ মাত্রা )। 
আর একটা কবিতা: 
আসতে-যেতে এখনো তুলি চোখ 
রেলিঙে আর দেখিনা নীল শাড়ি। 
কোথায় যেন জমেছে কিছু শোক, 
ভেঙেছ খেলা সহসা দিয়ে আড়ি। 
এখন সব স্তব্ধ নিরালোক; 
অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে বাড়ি। 
—নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। 
ভেঙে দেখালে— 
আসতে-যেতে / এখনো তুলি / চোখ 
রেলিঙে আর / দেখিনা নীল / শাড়ি। 
কোথায় যেন / জমেছে কিছু / শোক, 
ভেঙেছ খেলা / সহসা দিয়ে / আড়ি। 
এখন সব / স্তব্ধ নিরা / লোক; 
অন্ধকারে / ঘুমিয়ে আছে / বাড়ি। 
*দুটো করে ৫ মাত্রার পর্ব সাথে ২ মাত্রার ভাঙা পর্ব। 
আগেই মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে আমরা ঘোড়ার চালের সাথে তুলনা করেছি। আপনারা সবাই নিশ্চয় অশ্বখুরধ্বনি শুনেছেন? ৪ মাত্রার চাল এর ধ্বনি যদি হয় খট্ খট্, খট্, খট্; ৫ মাত্রার ধ্বনি তবে খটাশ খট্, খটাশ খট্। অন্য কথায় বলা যায়- বেজোড় জোড়, বেজোড় জোড়। মাঝে মাঝে অবশ্য জোড়-বেজোড় হয়ে গেলে তেমন কিছু দোষের নয়। 
মাত্রাবৃত্তে ৬ মাত্রার ছন্দ 
উদাহরন দেয়া যাক: 
খেলার মধ্যে ভুল হলে আর নতুন খেলার 
সুযোগ তো নেই। তলিয়ে যাচ্ছো ভুল আবর্তে, 
আসবেনা কেউ অন্ধকারের অতল গুহায়। 
*খুব একটা সুবিধার হলনা। তবু এখানে দুটো বিষয় দেখাচ্ছি- ১/ ভাঙা পর্ব রাখিনি, ২/অন্ত্যমিল রাখিনি। ভেঙেদেখাবো না কি আপনারাই ভেঙে দেখবেন? 
আরেকটা উদাহরন দেই। এবারে নীরেন্দ্রনাথ থেকে: 
যন্ত্রণা থেকে আনন্দ জেগে ওঠে 
শোক সান্ত্বনা হয়; 
কাঁটার ঊর্ধ্বে গোলাপের মতো ফোটে 
সমস্ত পরাজয়। 
ভাঙলে— 
যন্ত্রণা থেকে / আনন্দ জেগে / ওঠে 
শোক সান্ত্বনা / হয়; 
কাঁটার ঊর্ধ্বে / গোলাপের মতো / ফোটে 
সমস্ত পরা / জয়। 
*এখানে দেখলাম সব লাইনে পর্ব সংখ্যা সমান নয়। প্রথম আর ৩য় লাইনে ২টি করে পর্ব, কিন্তু ২য় আর ৪র্থ লাইনে ১টি করে পর্ব। আবার অন্ত্যমিলেও বৈচিত্র্য- ১ম-৩য়, ২য়-৪র্থ। ভাঙা পর্ব অবশ্য সবখানেই ২ মাত্রার। পর্বসংখ্যায় এই বৈবিচিত্র্যের নিরীক্ষাটি অবশ্য রবীন্দ্রনাথের আগেই শুরু করেন কবি বিষ্ণু দে। 
৭ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত 
এটা শেষ করতে পারলে এই যাত্রা বেঁচে যাই। ৪, ৫, ৬ মাত্রার তুলনায় ৭ মাত্রায় লেখা কবিতার সংখ্যা খুব কম। রবীন্দ্রনাথের পরেও অনেকে ৭ মাত্রায় লিখেছেন, তবে আজকাল তেমন একটা দেখিনা। একটা উদাহরন দিয়েই ইতি টানবো: 
কে যেন বারেবারে তার পুরনো নাম ধরে ডাকে; বেড়ায় পায়েপায়ে, আর কাঁধের পরে হাত রাখে। 
ভাঙলে এ রকম– কে যেন বারেবারে / তার পুরনো নাম ধরে / ডাকে; বেড়ায় পায়েপায়ে, / আর কাঁধের পরে হাত / রাখে। 
আলোচনা আপাতত এখানেই শেষ করছি। সবাই অনেক ভাল থাকুন।
 
সহায়ক গ্রন্থ সূত্র: 
কবিতার ক্লাস – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ছন্দের বারান্দা – শঙ্খ ঘোষ, ঈশ্বরীর স্বরচিত ও অন্যান্য নিবন্ধ – বিনয় মজুমদার, সাহিত্য সন্দর্শন – শ্রীশচন্দ্র দাশ

আপনার মতামত লিখুন :

প্রবন্ধ, লেখক: রুদ্র অয়ন, ঢাকা