ডুমুরিয়ায় এনজিও কিস্তি না দেয়ায় লুট করছে ধান ও গৃহপালিত পশু

প্রকাশিত: ৪:০০ অপরাহ্ণ, জুন ১১, ২০২০ | আপডেট: ৪:০০:অপরাহ্ণ, জুন ১১, ২০২০

প্রাণঘাতি করোনা পরিস্থিতে সারাদেশে চলছে লকডাউন। কৃষক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রমিক দিনমজুর তথা খেটে খাওয়া মানুষ ৩ মাস কর্মহীন। দীর্ঘদিনের অচলাবস্থায় সাধারণ মানুষ এখন চরম বিপাকে। পেটে দুবেলা দুমুঠো খাবার জুটাতে তারা সরকারি ত্রাণ সামগ্রীর উপর নির্ভরশীল। সঞ্চয়কৃত পুঁজি সব খেয়ে ফেলেছেন।

সোহাগ মাল্টিমিডিয়া এন্ড ট্র্যাভেলস

জীবন বাঁচাতে আতঙ্কের মধ্যে কেউ কেউ শ্রম বিক্রি করলেও শূন্য হাতে বিগত দিনের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতেই হিমশিম খাচ্ছেন। দৈনন্দিন সাংসারিক খরচ মিটিয়ে খেটে খাওয়া মানুষ এনজিও’র ঋণের কিস্তি পরিশোধের মত অতিরিক্ত আয় নিশ্চিত করতে পারছেন না। এনজিও কর্মীরা এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিস্তি আদায়ে ঋণগ্রহীতাদের সাথে অনামানবিক আচারণ করছে। কিস্তি আদায় করতে না পেরে কর্মীরা জোর করে নিয়ে গেছে ঋণগ্রহীতার ধান ও গৃহপালিত পশু। এনজিও’র কিস্তির খড়গ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে।

বৈশ্বিক করোনা কারণে গত ২৪ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারীভাবে এক নির্দেশনার মাধ্যমে এনজিওকে ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ করতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু ২জুন লকডাউন তুলে নেয়ার পর দিন থেকেই এনজিওগুলোর কর্মী বাহিনী মাঠে নেমে পড়েছেন কিস্তি আদায়ে। অথচ সাধারণ মানুষ তাদের আয়ের ব্যবস্থাই ঠিক করে উঠতে পারেননি। অনেকে পূর্বের কর্ম হারিয়ে নতুন করে কর্ম খোঁজে ছিলেন। আবার অনেকে কাজে যোগ দিলেও মজুরী বা বেতন পেতে নুন্যতম হলেও একমাস বা এক সপ্তাহ সময় লাগবে। করোনা পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নেয়ায় আজ (১১ জুন) সকাল থেকে খুলনায় আবারও লকডাউন ঘোষণা করেছেন। কিন্তু থেমে নেই এনজিও’র কিস্তি আদায়ে তৎপরতা। সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র আরও নিম্নমুখি । তাদের দাবি করোনার ওসিলায় অনেক দিন ছাড় পেয়েছেন। এখন আর কোন ছাড় দেয়া হবেনা। কিস্তি ঠিক মত না দিলে ভবিষ্যতে ঋণ পাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে বলেও ভয় দেখানো হচ্ছে।

খবর নিয়ে জানা যায়, আশা, ব্র্যাক, গ্রামীণ, বন্ধুকল্যাণ, দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন, জনতা, জাগরনী চক্র ফাউন্ডেশনসহ সকল এনজিও গ্রাহকদের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন যে জুনের ২ তারিখের পর থেকে কিস্তি দিতেই হবে। তারপর থেকে অনেক এনজিও বাড়ি বাড়ি এসে জোরপূর্বক কিস্তি নিয়ে যাচ্ছেন। পাইকগাছা উপজেলার গজালিয়া গ্রামের অর্ধেন্দু রায় জীবীকার তাগিদে ডুমুরিয়া উপজেলার রামকৃষ্ণপুর বিলে জমি হারি নিয়ে মাছ ও ধান চাষ করেন। আর্থিক সঙ্কটে পড়ে স্থানীয় নবরূপ ও পূর্বাশা সমবায় সমিতি থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। কিস্তির টাকা অর্ধেন্দু ঠিকমত পরিশোধ করে আসছিলেন। কিন্তু ঘূণিঝড় আম্পান ও মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশনায় কিস্তির টাকা দেননি। ২ জুন নবরূপ ও পূর্বাশা সমবায় সমিতির লোকেরা ঘেরে মাড়াই করে রাখা ১২৫ বস্তা ধান ও ২টি শুকর ঝোর করে নিয়ে যান। নবরূপ সমিতির লোকজন শুকর দুটি মেরে তার মাংস বিক্রি করে দেন। ছাগল ও ৪৫ বস্তা ধান পূর্বাশা সমিতির লোকেরা অন্য একজনের জিম্মায় রেখেছেন বলে তারা জানান।

নবরূপ সমবায় সমিতির কোষাধ্যক্ষ পিন্টু কবিরাজ এ বিষয়ে জানান, অর্ধেন্দুর কাছে সুদ ও আসলসহ অনেক টাকা পাওনা রয়েছে। সে টাকা না দিয়ে চলে যেতে পারে তাই সমিতি যে টাকা পাবে সে অনুযায়ি ধান ও শুকর আনা হয়েছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা সেলিম আকতার নবরূপ সমিতির এই আচরণের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, তারা সরকারের নির্দেশ অমান্য করেছে। তাদের এহেন ভূমিকা সম্পদ লুট করার সামিল। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধেন্দু রায়কে সমিতির লোকদের আইনের আওতায় আনতে সবরকমের সহায়তা দেয়া হবে।
ডুমুরিয়া উপজেলার আন্দুলিয়া গ্রামের মোল্যা পাড়ার জোহরা বেগম উদ্দীপন সংস্থা থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সাপ্তাহিক কিস্তি ৫’শ টাকা। ৯জুন সকালে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শাহপুর অফিসের উদ্দীপনের মাঠকর্মী সাইফুল ইসলাম মাস্ক ছাড়া ঐ বাড়িতে নাছোড় বান্দার মত বসে আসেন। কিস্তি না নিয়ে যাবেন না। তার বস নাকি কিস্তি না নিয়ে অফিসে ঢুকতে নিষেধ করেছেন। জোহরা বেগম জানান; সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি কিস্তির টাকা কিভাবে দেব।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের দিনমজুর শঙ্করী মন্ডল, হাসানপুর গ্রামের আমেনা, চেঁচুড়ি গ্রামের শেফালী, রংপুরের দিপালী, শাহপুর গ্রামের রোজিনা, আন্দুলিয়া গ্রামের নাসিরুদ্দিন মোল্যার স্ত্রী আকলিমা, থুকড়ার সোহরাব শোলগাতিয়া গ্রামের আয়শাসহ অন্তত: ১৫জন ঋণগ্রহীতা বলেন; তারা কেউ শ্রমিক আবার কেউ দিনমজুর। এনজিও থেকে লোন নিয়ে গরু- ছাগল পালন করছেন। আবার কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। আবার কেউ ঘেরে মাছ ছেড়েছেন। তারা এলাকার বাহিরে গিয়ে বিভিন্ন কাজ করে থাকেন।
কিন্তু করোনা ভাইরাস আতঙ্কে অনেকেই গ্রামে এবং বাহিরে কোথাও কাজের জন্য যেতে পারছেন না। অথচ এনজিও কর্মিরা ভোরে বাড়িতে এসে বসে কিস্তির জন্য চাপ দিচ্ছে। কিস্তি দিতে না পারলে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করছে। এখন কিস্তি পরিশোধের জন্য সাধারণ মানুষের উপর চাপ দেয়ায় তারা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে।

উপকূলীয় কয়রার শাহানাজ খাতুন বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ইট, বালুর ব্যবসা করেন, পান ব্যবসায়ী সাদ্দাম, ছিট কাপড় ব্যবসায়ী সানি, চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ী আলাউদ্দীন, পল্টি খামার ব্যবসায়ী সবুজ আম্পানের ছোবলে পথে বসেছেন। কয়রার এরকম ছোট বড় হাজারো ব্যবসায়ী ও উদ্যোগী যাদের এনজি লোনের কিস্তিতো দূরের কথা নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই, নেই পরিবারের সদস্যদের মুখে দু- মুঠো খাবার তুলে দেবার ক্ষমতা ৷ তাদের মধ্যে বিভিন্নজনের সাথে আলাপকালে অনেকেই বলেন, আল্লাহ যদি আমাদের একেবারেই তুলে নিতো তাহলে বেঁচে যেতাম আমরা কোথায় পাব পুঁজি, আর কোথা থেকে আসবে কিস্তির টাকা৷ ডুবছে জমি,ভাসছে মাছের ঘের এভাবে হা-হাকারে জীবন কাটছে যাদের। জীবনতো নয় যেন কষ্টের মরুভুমি। তারা চায় আবার আগের মত ঘুরে দাঁড়াতে, মজবুত টেকসই বেড়িবাঁধ হলে এবং স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এলে তারা লোনের কিস্তি দিতে পারবেন।

ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোছা. শাহনাজ বেগম জানান; যে সমস্ত হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ঋণের কিস্তি দিতে অসুবিধা হচ্ছিল। এ বিষয়টি বিবেচনায় করোনা পরিস্থিতি শিথিল না হওয়া পর্যন্ত এনজিগুলোকে সরকার আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত কিস্তি আদায় না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে পরবর্তী নির্দেশনা সরকারের পক্ষে কোন আসেনি।

ভুক্তভোগী ও সচেতনমহলের দাবি চলমান এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনের পুনরায় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা জেলা প্রশাসকের কাছে দাবি জানিয়েছেন ঋণের কিস্তি আদায়ের ক্ষেত্রে সময় দেয়ার জন্য এনজিওগুলোর প্রতি নির্দেশনা প্রদানের। মানবিক দিক বিবেচনা করে এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান এখন একান্ত প্রয়োজন।


আপনার মতামত লিখুন :

গাজী আব্দুল কুদ্দুস। নিজস্ব প্রতিবেদক। চুকনগর, খুলনা