কপিলমুনি রাজাকার মুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের এ দিনে

প্রকাশিত: ১০:৫৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৮, ২০১৯ | আপডেট: ১০:৫৮:অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৮, ২০১৯

আমিনুল ইসলাম বজলু:
৯ ডিসেম্বর। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি রাজাকার মুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের এ দিনে। দ্বিতীয় দফায় দীর্ঘ ৪৮ ঘন্টার সম্মুখ সময় যুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর রাজাকারদের আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে পতন ঘটেছিল দক্ষিণ খুলনার সবচেয়ে সমালোচিত ও বড় রাজাকার ঘাঁটিটির। এসময় উপস্থিত হাজার হাজার জনতার রায়ে ১৫৬ জন রাজাকার কে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। যুদ্ধকালীন এত সংখ্যক রাজাকারদের জনতার রায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা সম্ভবত সেটাই প্রথম।
তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দোসররা সারা দেশব্যাপী সাধারণ নিরিহ মানুষের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার নির্যাতন চালাতে থাকে। আর এ অত্যাচারে অতিষ্টি হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মত পাইকগাছার সর্বত্র প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে উছে। এ সময় পাক দোসররা বিশাল অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কপিলমুনিতে ঘাটি করে। অত্যাচারী বহু পরিবার সে সময় বিদেশে পাড়ি জমায়। কপিলমুনি শহরে পরিত্যাক্ত রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটি পাকিস্তানি দোসররা ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয়। তখন এলাকায় নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। প্রতিদিন বিকাল ৪ টা থেকে ভোর ৬ টা নাগাদ কারপুজারী করা হত। এলাকার নিরিহ মানুষদের ধরে এনে কপোতাক্ষ নদীর তীরে ফুলতলা নামক স্থানে শরীরের বিভিন্ন অংশে কেটে লবণ দেয়া হত। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাইকগাছার রাড়–লী, বাঁকা, বোয়ালিয়া ও গড়ইখালী প্রতিরোধ দুর্গোকে মুক্তিফৌজের ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। তাগিদ পড়ে কপিলমুনি শত্রু ঘাটি পতনের। কারণ খুলনাঞ্চলের মধ্যে কপিমুনির শত্রু ঘাঁটি ছিল সবচেয়ে বড় ঘাঠটি। সাড়ে ৩ শ’র বেশী পাক সেনা ও তাদের দোসররা এখানে অবস্থান নেয়। ছাদের উপর তাক করা হয় ভারী কামান ও মেশিন গান। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর খুলনাঞ্চলের সকল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ একত্রে মিলিত হন মাগুরার শান্তি বাবুর দোতলায়। সিদ্ধান্ত হয়, যে কোন মূল্যে কপিলমুনিকে মুক্ত করতেই হবে। এর আগে আরো একবার শত্র“ঘাটি আক্রমন হলেও জনতার অসহযোগিতায় সেবার ব্যর্থ হয় পাইকগাছার রাড়–লী ও হাতিয়ারডাঙ্গা ক্যাম্প কমান্ডারগণ যুদ্ধের একটি পরকল্পনা প্রণয়ন করেন। নৌ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী রহমত উল্ল¬া দাদু, স ম বাবর আলী, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, গাজী রফিক, ইউনুস আলী ইনু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর, শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু, মোল্যা আব্দুস সালাম, আবুল কালাম আজাদ কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।


সোহাগ মাল্টিমিডিয়া এন্ড ট্র্যাভেলস

অবশেষে ৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে চারিদিক থেকে কপিলমুনি শত্রুঘাটি আক্রমন করা হয়। হঠাৎ রাইফেলের গুলির ঠাশ-ঠাশ আওয়াজ মুহুর্তে ভারী অস্ত্র কামান, মেশিনগানের বিকট শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায় মানুষের। যার যার মত বাড়ির বারান্দার নীচে পজিশন নেয় প্রাণ ভয়ে। স্থানীয় প্রতাপকাটি কাঠের ব্রীজের উপর ৮ জন রাজাকার, তার একটু পেছনে আরো ৫জন রাজাকার যুদ্ধে মারা যায়। একেরপর এক মরতে থাকে পাক দোসর রাজাকারদলের সদস্যরা।
দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১ টার দিকে অস্ত্র ফেলে সাদা পতাকা উচিয়ে ১৫৬ জন পাকিস্তানি দোসর আত্মসমার্পণ করে। এরপর সেখান থেকে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে ৪ জন পালিয়ে যায়। সাথে সাথে পতন ঘটে খুলনাঞ্চলের বৃহত্তম শত্র“ ঘাঁটির। এরপর শত্রুদের বন্দী করে নিয়ে আসা হয় ঘাঁটির সামনের কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল এন্ড কলেজের ঐতিহাসিক ময়দানে। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটির অভ্যন্তরে ঢুকে সেখানে দেয়ালের গায়ে পেরেক বিদ্ধ মাছিয়াড়ার রহিম বক্স গাজীর ছেলে সৈয়দ আলী গাজীর ঝুলন্ত লাশ দেখে সকলে আৎকে উঠেন। এখবর মূহুর্তে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে এলাকার হাজার হাজার জনতার ঢল নামে সেখানে। উপস্থিত জনতার গণদাবির প্রেক্ষিতে তাদেরকে প্রকাশ্যে জনতার আদালতে গুলি করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এসময় অধিকতর অপরাধীদের ১১ জনকে চিহ্নিত করে আলাদা ভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে ও রাইফেলের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ঐ দিন নিহত রাজাকারদের অধিকাংশ পরিবার তাদের লাশ বুঝে নিলেও লজ্জা, ঘৃণা সহ নানা কারণে অনেকের লাশ গ্রহণ করেনি তাদের পরিবার। যাদেরকে মাঠের পশ্চিম প্রান্তে গণকবর দেয়া হয় বলেও সূত্র জানায়। দীর্ঘদিন সেখানে এলাকাবাসী মূত্র ত্যাগ করত। এযুদ্ধে শহিদ হন দু’জন মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে খুলনার বেলফুলিয়ার আনোয়ার হোসেন ও সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামের আনছার আলী গাজী। আহত হন মোহাম্মদ আলী, তোরাব আলী সানা সহ অনেকে।
তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ঘটা করে পালিত হয়না কপিলমুনি শত্রু মুক্ত দিবস। ৭ ডিসেম্বর নাকি ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস? অনেকে ঐ যুদ্ধে নিহত রাজাকারদের কবরের গায়ে লিখিত তারিখ দেখে নির্ধারণ করতেন কপিলমুনি মুক্ত দিবসের তারিখ। মুক্তিযোদ্ধাদের তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ দিবসটি পালিত হত না। তবে ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে ৯ ডিসেম্বরকে কপিলমুনি মুক্ত দিবস ঘোষণায় ঐক্যমতে পৌছান সকলে।


এবিষয়ে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা এ্যাডঃ সম বাবর আলী জানান, ৭ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস। সারা দেশের মত কপিলমুনি মুক্ত দিবস নিয়েও বিতর্কীত আছে। তখন কপিলমুনিতে মুক্তিযোদ্ধা ছিল চারজন তারা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে এদের কেউ কেউ দ্বিমত করে ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস বলে।

 

 

সুন্দরবনটাইমস.কম/আমিনুল ইসলাম বজলু/পাইকগাছা



আপনার মতামত লিখুন :

নিজস্ব প্রতিবেদক