প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সাতক্ষীরায় হুমকির মুখে পড়েছে চিংড়ী চাষিরা

প্রকাশিত: ৩:৪৫ অপরাহ্ণ, মে ১০, ২০২০ | আপডেট: ৩:৪৫:অপরাহ্ণ, মে ১০, ২০২০

করোনার প্রভাবে বিদেশে রপ্তানি বন্ধ থাকায়  সাতক্ষীরায় হুমকির মুখে পড়েছে চিংড়ী শিল্প। রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়  চিংড়ি শিল্পে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এ শিল্পের সাথে জড়িত কয়েক লাখ চাষি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ’ হয়ে পড়েছেন। জেলার বাজার গুলো গলদা ও বাগদা চিংড়িতে ভরে গেছে। চাহিদার তুলনা উৎপাদন বেশি হওয়ায় ১২০০ টাকা কেজি প্রতির মাছ ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাড়াতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংক ঋণসহ  সুদ মৌকুফের দাবি জানিয়েছেন চিংড়ী চাষিরা। 

সোহাগ মাল্টিমিডিয়া এন্ড ট্র্যাভেলস

দক্ষিণাঞ্চলে আশির দশক থেকে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় কয়েক লাখ চাষি বাণিজ্যিক ভাবে চিংড়ি চাষ করে আসছেন। এই অঞ্চলে চিংড়ি চাষ লাভজনক হওয়ায় সাদা সোনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যার ফলে দিন দিন চাষির সংখ্যা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এই চিংড়ি শিল্প থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আসে।

সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৭০ হাজার চিংড়ি ঘের রয়েছে। এ সব ঘেরে গলদা ও বাগদা চিংড়ী চাষ হয়ে থাকে। চলতি বছরে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে হুমকির মুখে পড়েছে চিংড়ী শিল্প। বিদেশে রপ্তানি ও কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাতক্ষীরার স্থানীয় বাজার গুলোতে চিংড়ী বাজারজাত করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অস্বাভাবিক হারে গলদা ও বাগদা চিংড়ী মাছের দরপতন হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে ঘের মালিকদের। সময় মতো ব্যাংক ঋণ ও সমিতির কিস্তি নিয়ে দুঃ চিন্তাই রয়েছে চিংড়ি ঘের মালিকরা। এ অবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রান্তিক চাষিরা।

সূত্র জানায়, দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৩ হাজার টন রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সাতক্ষীরায় উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৫০০ টন। অর্থাৎ মোট রফতানিযোগ্য চিংড়ির প্রায় ৩০ শতাংশই উৎপাদন হয় সাতক্ষীরা জেলায়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে টিকে থাকতে পারছে না সাতক্ষীরার প্রক্রিয়াকরণ চিংড়ি কারখানাগুলো।

এতে লোকসানের মুখে পড়েছে স্থানীয় কারখানাগুলো। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে একাধিক কারখানা। করোনার কারণে সব সেক্টরের সাথে চিংড়ি সেক্টরও হুমকির মুখে পড়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে, নতুন বাজার সৃষ্টিসহ ঘুরে দাঁড়াবে সম্ভাবনার এ এখাতটি আশা সংশ্লিষ্টদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরার ৬টি উপজেলার অর্ধলক্ষ হেক্টর জমিতে সাদা সোনা খ্যাত এই চিংড়ি চাষ করা হয়। বাগদা চিংড়ির পাশাপাশি গলদা ও হরিণা প্রজাতির মাছ চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বাগদা ও গলদা দেশের বাইরে রপ্তানি হয় এবং হরিণা চিংড়ি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। চিংড়ি রপ্তানি করে সাতক্ষীরা থেকে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বৈদেশীক মুদ্রা অর্জিত হয়।

কিন্তু চলতি ২০২০ মৌসুমে চিংড়িতে ব্যাপক হারে ভাইরাস ও মড়ক এবং সর্বশেষ করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিদেশে চিংড়ি রপ্তানি বন্ধ থাকায় মাছের দাম স্থানীয় বাজারে কমে যাওয়াতে চাষিরা বসার উপক্রম হয়েছে। চলতি মৌসুমে মড়কে প্রায় ১০০ কোটি টাকার উপরে চিংড়ি মাছ মরে গেছে। তবে জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঘেরে পানি সল্পতা, পরিবেশ সম্মত না হওয়া এবং রেনু পোনা জীবাণুমুক্ত না হওয়ায় ভাইরাস দেখা দিচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস জানায়, চলতি ২০২০ মৌসুমে সাতক্ষীরার ছয়টি উপজেলার ৪৯ হাজার ১৬৩টি নিবন্ধিত ঘেরে রপ্তানিজাত বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ২ হাজার ১০৫টি, তালায় ১ হাজার ২৯৫টি, দেবহাটায় ২ হাজার ৮২৯টি, আশাশুনিতে ১৩ হাজার ২১৭টি, কালিগঞ্জে ১৪ হাজার ৫৫৯টি ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৫ হাজার ১৫৮টি ঘেরে রপ্তানিজাত বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষে নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। বিগত মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার মেট্রিকটন।

সময়ের ব্যবধানে সাতক্ষীরায় সাত থেকে আটটি চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরার বিনেরপোতার সুন্দরবন ফিশারিজ লিমিটেড, শহরের বাটকেখালী এলাকায় অবস্থিত করমেন্ডাল ফিশারিজ, উত্তর কাটিয়া এলাকার সাতক্ষীরা ফিশারিজ লিমিটেড, দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া এলাকায় অবস্থিত ছেকাই করপোরেশন লিমিটেড, চাঁদপুর ডেল্টা ফিশ লিমিটেড এবং শ্যামনগর উপজেলায় অবস্থিত পেঙ্গুইন কারখানা চিংড়ি সরবরাহ না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার চিংড়ি ব্যবসায়ী জি. এম গোলাম রসুল জানান, বিগত ৩০ থেকে ৩৫ বছর যাবত তিনি রপ্তানিজাত চিংড়ি উৎপাদন করনে। চলতি মৌসুমেও ২ হাজার ৫০০ বিঘা পরিমাণ জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। তবে গত এক দশকের মধ্যে চলতি মৌসুমে চিংড়ি চাষে সর্বচ্চো ক্ষতিগ্রস্থ’ হয়েছেন বলে জানান তিনি। বর্তমানে সাতক্ষীরায় প্রতি কেজি চিংড়ি প্রকারভেদে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আশাশুনি উপজেলার চিংড়ি ব্যবসায়ী হযরত আলী বিপ্লব বলেন, স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করলে দাম কম পাওয়া যায়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও খুলনার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি কেজি চিংড়ির দাম প্রকারভেদে প্রতি কেজিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি পাওয়া যায়। ফলে চিংড়ি ঘাটতিতে সংকটের মুখে সাতক্ষীরার প্রক্রিয়াকরণ কারখানা গুলো।

সাতক্ষীরা চিংড়ি চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক চিংড়ি চাষি ডাক্তার আবুল কালাম বাবলা বলেন, চলতি মৌসুমে প্রায় দেড় হাজার বিঘার ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। কিন্তু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঘেরের অধিকাংশ চিংড়ি মরে গেছে। তিনি আরো বলেন, ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে চলতি মৌসুমে আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে আরো প্রায় ১০০ বিঘা পরিমাণ পুকুরে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। কিন্তু তাতেও মড়ক লেগে সমুদয় চিংড়ি মরে গেছে। এতে ১ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে তার।

চিংড়ি চাষি ডাক্তার আবুল কালাম বাবলা তিনি আরো বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় বিভিন্ন চিংড়ি ঘেরে মড়ক লেগে যে পরিমাণ চিংড়ি মারা গেছে তার মূল্য কমপক্ষে ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকার মত হবে। এছাড়া করোনা ভাইরাসের কারণে বিদেশে মাছ রপ্তানি বন্ধ থাকায় চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এ জেলার চিংড়ি চাষীরা।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান বলেন, দেশের পরিবেশ স্বাভাবিক হলে আবারো চিংড়ি শিল্পে প্রাণ ফিরে পাবে। চিংড়ি শিল্পে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে জেলা মৎস্য বিভাগ চাষীদের পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগীতা দিয়ে যাচ্ছে। মাছ বাজারজাতকরণের ব্যাপারেও উদ্যোগ নিবেন তারা।

মো. মশিউর রহমান আরো বলেন, রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি উৎপাদন হয়, তার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশই চলে যায় চট্টগ্রাম ও খুলনার কারখানাগুলোয়। তারা মাছ কেনা শুরু করেছে। চলতি সপ্তাহে চিংড়িতে কেজি প্রতি একশ’ থেকে দেড়শ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছ।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, ক্ষতিগ্রস্থ চিংড়ী চাষীদের ডাটাবেজ তৈরি কাজ চলছে। পাশাপাশি সুদ মৌকুফ ও চিংড়ীর ফ্রোজেনের ব্যবস্থা করা হবে ।


আপনার মতামত লিখুন :

নিজস্ব প্রতিবেদক। ডেক্স