কপিলমুনিতে চলছে খেজুর রস সংগ্রহ

প্রকাশিত: ৮:০৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯ | আপডেট: ৮:০৬:অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯

প্রতিবেদক, কপিলমুনি(খুলনা):
কপিলমুনিতে ফসলী জমিতে লীজ ঘের করায় খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। যে কয়টা খেজুর গাছ নজরে পড়ে তাও তোলার জন্য এলাকায় পর্যাপ্ত গাছি সংকট চলেছে।
ঋতু চক্রের পালাবদলে শরৎ কে বিদায় জানিয়ে এসেছে শীত। সকালের দূর্বাঘাস ও পাতা-পল্লবেও এসেছে শিশিরের ছোঁয়া। রাতের শেষ ভাগে শিশিরের টাপুর-টুপুর মন মাতানো শব্দ পুলকিত করছে অন্যভাবে। শুরু হয়েছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর গাছ উঠানোর (রস সংগ্রহের) কাজ।


সোহাগ মাল্টিমিডিয়া এন্ড ট্র্যাভেলস

জানাযায়, ৯০’র দশকের আগে পর্যন্ত খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের প্রান্তর জুড়ে যতদূর চোখ যেত, ছিল সবুজের সমারোহ। সবুজে-শ্যামলে ভরে থাকত সারা মাঠ। ক্ষেতের ভেঁড়ি বা আইল দিয়ে সারি সারি দেখা মিলত হাজার হাজার খেজুর গাছ, কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সবকিছুই যেন অতীত। আর এখন প্রান্তর জুড়ে ধানের পরিবর্তে চাষ হয় চিংড়ির। বলা চলে নগরায়নের প্রতিযোগীতায় ইট ও টালীর ভাটা বিরামহীণ গতিতে গিলে খাচ্ছে কালের স্বাক্ষী খেজুর গাছগুলোকে। শীতের সকালে সোনালী রোদের সাথে মিষ্টি খেজুরের রসের স্বাদও যেন তাই আজ ভূলতে বসেছে চিরচেনা জনপদের মানুষরা। তবুও যেখানে যে গাছ গুলো এখনও নিরবে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোকে নিয়েই যেন গাছিদের শুরু হয়েছে অন্য রকম ব্যস্ততা।


কপিলমুনিতে ছোট বড় মিলে অসংখ্য লবণ পানির চিংড়ি মাছের ঘের রয়েছে। মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়ে বেড়ে গেছে অম্লতা। বছরের সারাটা সময় জুড়ে একদিকে যেমন খেজুর গাছের প্রতি ভাটা সমূহের চোখ রাঙানি অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ে গাছের অকাল মৃত্যু। সব মিলিয়ে জনপদ থেকে সাবার হয়েই চলেছে মিষ্টি রসের অফুরন্ত ভান্ডার খেজুর গাছ। তাই গাছের সাথে সাথে গাছিরাও যেন তাদের পেশা পরিবর্তন করে চলে গেছে অন্য পেশায়। কোন কোন এলাকায় যারা এখনও বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে পড়ে আছেন গাছির পেশায় তাদেরও যেন যায় যায় অবস্থা। এ প্রসঙ্গে কথা হয় প্রবীণ গাছি সবুর মোড়লের সাথে। কেমন যাচ্ছে তার দিন-কাল এমন প্রশ্ন করতেই যেন বড় একটা দীর্ঘশ্বাস, তার পর ছল-ছল চোখে বললেন, এলাকায় এখন খেজুর গাছই নেই, তাই তাদের আর ভাল থাকা! মাঠের দিকে যাচ্ছেন, সেদিকের মাঠে নাকি এখনও কিছু কিছু গাছ রয়েছে।


প্রসঙ্গত, খেজুর গাছের অগ্রভাগের একটি নির্দিষ্ট অংশ চিরে বিশেষ ব্যবস্থায় ছোট কলসি (ভাড়) বাঁধা হয়। ফোঁটায় ফোঁটায় রসে পূর্ণ হয় সে কলসি। তাই রসের সন্ধানে খেজুর গাছ তোলা কাটাসহ বিভিন্ন রকমের পরিচর্যা-প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা। যদিও এখন গাছিরা গাছিনী বা তাদের বউদের ছন্দ বা গানের সুরে বলেননা ”ঠিলে ধুয়ে দে-রে বউ গাছ কাটতে যাব”। ছোট হোক বা বড়, খেজুর গাছে বেশ ঝুঁকি নিয়েই তোলা কাটা করতে হয়। কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে গাছ তোলার কাজ করতে হয়। এছাড়া রস সংগ্রহের পাত্র ভাঁড়, ঠিলে বা কলস প্রস্তুত করতেও তা নিয়মিত আগুনে পোড়াতে হয়। এলাকাবাসী খেজুর গাছ উজাড়ের জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী করেছেন এলাকার ইট ও টালির ভাটা মালিকদেরকে। কেননা খেজুর গাছের চাহিদাটা ভাটা গুলোতেই বেশী। এছাড়া প্রান্তর জুড়ে চিংড়ি চাষ হওয়ায় ঘের প্রস্তুত করতে খেজুর গাছ কাটতে হয়। নানান কারণে তাই যেন আজ গ্রাম-বাংলা থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে খেজুর গাছ।


তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, যশোরের পর এজনপদেই বেশী পরিমাণ খেজুর গাছ ছিল। তাই রসের পাশাপাশি চাহিদাতিরিক্ত গুড়ও উৎপাদিত হত এখান থেকে। বর্তমানে এলাকায় খেজুর গাছের দেখা কম মিললেও বছরের প্রায় সারাটা সময় জুড়ে কৃত্রিম পন্থায় চিনি জ্বালিয়ে তৈরি হয় খেজুরের গুড় বা পাটালি। আমাদের গ্রাম বাংলায় অতীতে খেজুর রসের যে সুখ্যাতি ছিল তা যেন তাই ক্রমেই কমে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন খেজুরের রস বিহীন শীতের সকালই জমতো না। সকালের সোনালী রোদে বসে মগ, গ্লাস বা ঘটে করে মিষ্টি রসের চুমুক না হলে যেন খালি খালি লাগত। সান্ধ্য বা সেজো রস ছিল যেন আরো মজাদার। খেজুরের গুড় রসনা বিলাসি বাঙালীর সংস্কৃতিরই যেন একটা অংশ বলে মনে করেন স্থানীয়রা। ক’দিন পরেই প্রতিটি ঘরে খেজুরের রস দিয়ে পিঠা-পুলি-পায়েস তৈরীর ধূম পড়বে। ঢেঁকি ঘরে চাল কুটার ধুম পড়ে যাবে, শোনা যাবে ঢেঁকির ঢক ঢক শব্দ।

এলাকাবাসীর দাবি, খেজুর গাছের অবাধ নিধন বন্ধে সচেতনতার পাশাপাশি এগিয়ে আসুক প্রশাসন। শীতের খেজুরের রসনির্ভর সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় টিকে থাকুক খেজুর গাছ, টিকে থাকুক গাছি সম্প্রদায়।

 

 

 

সুন্দরবনটাইমস.কম/এইচ এম এ হাশেম/কপিলমুনি


আপনার মতামত লিখুন :

নিজস্ব প্রতিবেদক