সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত, তৃপ্তিদায়ক তালগাছ বিলুপ্তির পথে: সংরক্ষণ প্রয়োজন

প্রকাশিত: ১:৪৭ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৯, ২০১৯ | আপডেট: ১০:১৫:অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২২, ২০১৯

মো. আমিনুর রহমান সোহাগ:
নোবেল বিজয়ী ও বিশ্ব বরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তালগাছের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রচনা করেছিলেন, তালগাছ কবিতায়- ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে…….’ এবং খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন লিখেছেন, কানাবগীর ছা- ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ…..’। শুধু সৌন্দর্য বিমুগ্ধ নয় পাশাপাশি রসনা তৃপ্তিদায়ক তালগাছ সাতক্ষীরা জেলার সর্বত্র অপরিকল্পিতভাবে কাটা এবং যথাযথ রক্ষাবেক্ষনের অভাবে বিলুপ্ত হতে বসেছে।

সোহাগ মাল্টিমিডিয়া এন্ড ট্র্যাভেলস


সরেজমিনে জানা গেছে, জেলার তালা উপজেলা নয়, সমগ্র দেশের সর্বত্র গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যবহার এবং সবুজের ছায়াদান ছাড়াও রয়েছে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ প্রতিকৃত তালগাছ। পাশাপাশি তালগাছ অর্থকারী সম্পদও বটে। এক সময় গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে বাড়িতে কম-বেশি দু’একটি তাল গাছ থাকতো। আবহমান চির সবুজের এই বাংলার ঐতিহ্যের সাথে তালাগাছের সম্পর্ক- চিরচেনা, অত্যান্ত পুরানো, গাড়ো ও নিবিড়।


তালগাছ সাধারণত ২ ধরণের হয়ে থাকে। পুরুষ(স্থানীয় ভাষায় জটা) ও স্ত্রী( স্থানীয় ভাষায় ত্যালু)। স্ত্রী প্রজাতির গাছে প্রচুর তাল হয়ে থাকে। তাল মৌসুমে অনেকে তাল বিক্রয় করে সংসার চালাতো বলে অনেকে জানায়। গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহে গ্রামে, হাট-বাজারে কিম্বা অফিস আদালতে মানুষের যখন তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে আসে, ঠিক তখনি তারা সীমিত দামে কচি তালের কোয়া(স্থানীয় ভাষায় তালের চোখ) এবং তালের রস দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিত। যা তাদের জন্য অপর এক তৃপ্তি। তাল ব্যবসায়ীরা কচি তাল থেকে এমনভাবে কোয়া তুলে আনে তুলতুলে রসে ভরা টুইটুম্বর সাদা কুয়া গুলো দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। একটি তালে ২-৩টি কোয়া বা চোখ পাওয়া যায়। মিষ্টি রসে ভরা এবং খেতেও ভাল লাগে বলে সবাই জানায়। অপরদিকে পুরুষ তাল গাছে তালের পরিবর্তে গোলাকার চিকন লম্বা ছড়া আকৃতির অনেকগুলো জট হয়ে থাকে। স্ত্রী তাল গাছের তালের খাদি ছোট থাকতে এবং পুরুষ গাছের জট গ্রীস্ম ও বসন্তকালে বাঁশ বেয়ে গাছে উঠে বিশেষ পদ্ধতিতে কেটে ভাড়ে রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এই রস অত্যান্ত সু-স্বাদু ও মিষ্টি। অনেকের ধারণা জটা গাছের রস অনেক মিষ্টি। সুমিষ্ট রস মানুষের তৃপ্তি মেটায়। সুন্দর পায়েস রেধে খায়। পাশাপাশি রস জ্বাল দিয়ে গুড় ও পাটালি তৈরি করা যায়। গুড়ের সাথে তিল দিয়েও তিল পাটালি তৈরি করে থাকে গ্রামাঞ্চলের বধুরা। রস থেকে মিছরিও তৈরি হয়ে থাকে।
স্ত্রী তালগাছের যে তালগুলো কোয়া না খাওয়া হয় সে গুলো পূর্ণতা হলে সাধারণত ভাদ্র মাসে পেঁকে থাকে। পাঁকা তালের শ্বাস থেকে বিশেষভাবে নির্যাসিত লাল বর্ণের অত্যান্ত গাড় সুমিষ্ট রস খেতে খুবই সুস্বাদু। পাকা তাল থেকে পিঠা, পায়েস এবং বড়া সহ বিভিন্ন প্রকারের অত্যান্ত সুমিষ্ট তৃপ্তিদায়ক রুচিকর খাবার তৈরি করা হয়ে থাকে বলে অনেকে জানায়। বিশেষভাবে প্রস্তুত করে পাকা তালগাছ(পূর্ণ বয়স্ক) দিয়ে ঘরের চাল তৈরি করার জন্য বাটাম, রুয়া(স্থানীয় ভাষায় রো), তির, কৃষকের চাষকাজে ব্যবহৃত লাঙ্গলের ঈশ, পানি সেচ এবং বর্ষা মৌসুমে চলার জন্য ডুঙ্গা তৈরি করা হয়ে থাকে।


বিগত কয়েক বছর পূর্বেও গ্রামাঞ্চলের জমির আইল, পুকুর পাড়, রাস্তার পাশ সহ বিভিন্ন জায়গায় হাজারো গাছের মাঝে সারি সারি, আকাশে উঁকি মেরে থাকতে দেখা যেত তালগাছ। গাছের মাথায় লম্বা লম্বা মোটা ডাটা যুক্ত বড় বড় পাতা উপরের দিকে সোজা হয়ে এবং বাড়ন্ত পাতা গুলো নিচের দিকে ঝুলে থাকতো। বাতাসে তালপাতার মৃদমন্দের শব্দে এবং গাছের ছায়ায় বসে মানুষ পেত অপার এক তৃপ্তি। পাশাপাশি তালগাছের পাতায় ঝাঁকে ঝাঁকে বাবুই পাখি ঝুলন্ত বাসা/ঘর তৈরি করত। পাখির তৈরিকৃত ঘর আর শত শত পাখির কলকাকলিতে মুগ্ধ হয়ে থাকতো অনেকেই।
পাটকেলঘাটার তৈলকূপী গ্রামের শামীম(২২), বাইগুনী গ্রামের শিমুল(৩৫), কুমিরা গ্রামের লাল্টু(২৪) এবং থানা সদরের সৈয়দ শহিদুল ইসলাম(৫৫), মিঠাবাড়ী গ্রামের আনোয়ার আলী(৬০), রুহুল আমীন(৬০) বলেন, তালগাছ শুধু যে তার সৌন্দর্যে সকলকে মুগ্ধ করে রাখতো তা নয়। পাশাপাশি তালগাছের তালের ছোট খাদি ও জট থেকে বিশেষভাবে সংগ্রহকৃত রস এবং পাঁকাতাল থেকে তৃপ্তিদায়ক বিভিন্ন প্রকারের পায়েস, গুড়, পাটালি তৈরি করা যায়। পাকা গাছ কাটিয়ে ঘরে রো, বাটাম, তির কড়ি-বরগা, জানালার শিঁক তৈরি হত। কিন্তু এখন ভাল পাকা তালগাছ না থাকায় তাল কাঠের ব্যবহার নেই বললেই চলে। পাঁকাতাল ও রস তেমন পাওয়া যায় না। পাশাপাশি বাবুই পাখিও হারিয়ে যেতে বসেছে।


সার্বিক দিক বিবেচনা করে সর্ব মহলের ধারণা, তালগাছ ব্যবহার ও রসনা তৃপ্তির জন্য নয়, আমাদের সকলের জীবনে অতি প্রয়োজনে। পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সকলকে এগিয়ে এসে সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত তালগাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে অনন্তকাল।


আপনার মতামত লিখুন :

নিজস্ব প্রতিবেদক